কণিকা (কবিতা) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Konika poem Rabindranath Tagore

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

কণিকা (কবিতা) - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Konika poem Rabindranath Tagore

 

যথার্থ আপন

 

কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান,

বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান।

ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই,

চন্দ্রসূর্যতারকারে করে ‘ভাই ভাই’।

নভশ্চর ব’লে তাঁর মনের বিশ্বাস,

শূন্য-পানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস।

ভাবে, ‘শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে

বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতাডোরে;

বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে

উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।’

বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি—

সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।

 

হাতে-কলমে

 

বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক,

এরই তরে মধুকর এত করে জাঁক!

মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই,

আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই॥

 

গৃহভেদ

 

আম্র কহে, একদিন, হে মাকাল ভাই,

আছিনু বনের মাঝে সমান সবাই;

মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি—

মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি॥

 

গরজের আত্মীয়তা

 

কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে,

আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে?

থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে

আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে॥

 

কুটুম্বিতা

 

কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,

ভাই ব’লে ডাকো যদি দেব গলা টিপে।

হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা;

কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা॥

 

উদারচরিতানাম্

 

প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন

ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন।

ধিক্-ধিক্ করে তারে কাননে সবাই;

সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছি ভাই?।

 

অসম্ভব ভালো

 

যথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো,

কোন্ স্বর্গপুরী তুমি করে থাকো আলো?

আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায়

অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়॥

 

প্রত্যক্ষ প্রমাণ

 

বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ

আমার গর্জনে বলে মেঘের গর্জন,

বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে,

মাথায় পড়িলে তবে বলে— ‘বজ্র বটে!’

 

ভক্তিভাজন

 

রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম—

ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।

পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’,

মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’— হাসে অন্তর্যামী॥

 

উপকারদম্ভ

 

শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,

লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির॥

 

সন্দেহের কারণ

 

‘কত বড়ো আমি’ কহে নকল হীরাটি।

তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি॥

 

অকৃতজ্ঞ

 

ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে,

ধ্বনি-কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে॥

 

নিজের ও সাধারণের

 

চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে,

কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে॥

 

মাঝারির সতর্কতা

 

উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,

তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে॥

 

নতিস্বীকার

 

তপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয়,

তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়,

অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে

প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে॥

 

কর্তব্যগ্রহণ

 

কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি—

শুনিয়া জগত্‍‌ রহে নিরুত্তর ছবি।

মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,

আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি॥

 

ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তি

 

রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা

সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা॥

 

মোহ

 

নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,

ও পারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।

নদীর ও পার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে—

কহে, যাহা কিছু সুখ সকলই ও পারে॥

 

ফুল ও ফল

 

ফুল কহে ফুকারিয়া, ফল, ওরে ফল,

কত দূরে রয়েছিস বল্ মোরে বল্!

ফল কহে মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি—

তোমারই অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি॥

 

প্রশ্নের অতীত

 

হে সমুদ্র, চিরকাল কী তোমার ভাষা?

সমুদ্র কহিল, মোর অনন্ত জিজ্ঞাসা।

কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর?

হিমাদ্রি কহিল, মোর চিরনিরুত্তর॥

 

মোহের আশঙ্কা

 

শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা—

শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধ-ভরা;

বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,

আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো॥

 

চালক

 

অদৃষ্টেরে শুধালেম, চিরদিন পিছে

অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?

সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলেম থামি,

সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি॥

 

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।