১৩৩৩ (কবিতা) – জীবনানন্দ দাশ

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

১৩৩৩ (কবিতা) - জীবনানন্দ দাশ 1333 Poem By Jibanananda Das

 

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌ দিকে জানি নি তা — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন

চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে

কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে!

কত দেহ এল, গেল, হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে

দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে

নক্ষত্রের তলে

বসে আছি — সমুদ্রের জলে

দেহ ধুয়ে নিয়া

তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌দিকে — ফলে গেছে কতবার,

ঝরে গেছে তৃণ!

 

*

আমারে চাও না তুমি আজ আর, জানি;

তোমার শরীর ছানি

মিটায় পিপাসা

কে সে আজ! — তোমার রক্তের ভালোবাসা

দিয়েছ কাহারে!

কে বা সেই! — আমি এই সমুদ্রের পারে

বসে আছি একা আজ — ঐ দূর নক্ষত্রের কাছে

আজ আর প্রশ্ন নাই — মাঝরাতে ঘুম লেগে আছে

চক্ষে তার — এলোমেলো রয়েছে আকাশ!

উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা! — তারই তলে পৃথিবীর ঘাস

ফলে ওঠে — পৃথিবীর তৃণ

ঝড়ে পড়ে — পৃথিবীর রাত্রি আর দিন

কেটে যায়!

উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা — তারই তলে হায়!

 

*

জানি আমি — আমি যাব চলে

তোমার অনেক আগে;

তারপর, সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন —

আকাশে আকাশে যাবে জ্বলে

নক্ষত্র অনেক রাত আরো,

নক্ষত্র অনেক রাত আরো,

(যদিও তোমারও

রাত্রি আর দিন শেষ হবে

একদিন কবে!)

আমি চলে যাব, তবু, সমুদ্রের ভাষা

রয়ে যাবে — তোমার পিপাসা

ফুরাবে না পৃথিবীর ধুলো মাটি তৃণ

রহিবে তোমার তরে — রাত্রি আর দিন

রয়ে যাবে রয়ে যাবে তোমার শরীর,

আর এই পৃথিবীর মানুষের ভিড়।

 

*

আমারে খুজিয়াছিলে তুমি একদিন —

কখন হারায়ে যাই — এই ভয়ে নয়ন মলিন

করেছিলে তুমি! —

জানি আমি; তবু, এই পৃথিবীর ফসলের ভূমি

আকাশের তারার মতন

ফলিয়া ওঠে না রোজ — দেহ ঝরে — ঝরে যায় মন

তার আগে!

এই বর্তমান — তার দু — পায়ের দাগে

মুছে যায় পৃথিবীর পর,

একদিন হয়েছে যা তার রেখা, ধূলার অক্ষর!

আমারে হারায়ে আজ চোখ ম্লান করিবে না তুমি —

জানি আমি; পৃথিবীর ফসলের ভূমি

আকাশের তারার মতন

ফলিয়া ওঠে না রোজ —

দেহ ঝরে, তার আগে আমাদের ঝরে যায় মন!

 

*

আমার পায়ের তলে ঝরে যায় তৃণ —

তার আগে এই রাত্রি — দিন

পড়িতেছে ঝরে!

এই রাত্রি, এই দিন রেখেছিলে ভরে

তোমার পায়ের শব্দে, শুনেছি তা আমি!

কখন গিয়েছে তবু থামি

সেই শব্দে! — গেছ তুমি চলে

সেই দিন সেই রাত্রি ফুরায়েছে বলে!

আমার পায়ের তলে ঝরে নাই তৃণ —

তবু সেই রাত্রি আর দিন

পড়ে গেল ঝ’রে।

সেই রাত্রি — সেই দিন — তোমার পায়ের শব্দে রেখেছিলে ভরে!

 

*

জানি আমি, খুঁজিবে না আজিকে আমারে

তুমি আর; নক্ষত্রের পারে

যদি আমি চলে যাই,

পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই

যদি আমি —

আমারে খুঁজিতে তবু আসিবে না আজ;

তোমার পায়ের শব্দ গেল কবে থামি

আমার এ নক্ষত্রের তলে! —

জানি তবু, নদীর জলের মতো পা তোমার চলে —

তোমার শরীর আজ ঝরে

রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোনো এক ঢেউয়ের উপরে!

যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই

যদি আমি চলে যাই

নক্ষত্রের পারে —

জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

 

*

তুমি যদি রহিতে দাঁড়ায়ে!

নক্ষত্র সরিয়া যায়, তবু যদি তোমার দু — পায়ে

হারায়ে ফেলিতে পথ — চলার পিপাসা! —

একবারে ভালোবেসে — যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি সেই ভালোবাসা।

আমার এখানে এসে যেতে যদি থামি! —

কিন্তু তুমি চলে গেছ, তবু কেন আমি

রয়েছি দাঁড়ায়ে!

নক্ষত্র সরিয়া যায় — তবু কেন আমার এ পায়ে

হারায়ে ফেলেছি পথ চলার পিপাসা!

একবার ভালোবেসে কেন আমি ভালোবাসি সেই ভালোবাসা!

 

*

চলিতে চাহিয়াছিলে তুমি একদিন

আমার এ পথে — কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন।

জানি আমি, আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই।

তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি! — তাই আস নাই

আমার এখানে তুমি আর!

একদিন কত কথা বলেছিলে, তবু বলিবার

সেইদিনও ছিল না তো কিছু — তবু বলিবার

আমার এ পথে তুমি এসেছিলে — বলেছিলে কত কথা —

কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন;

আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই;

তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি — তাই আস নাই!

 

*

তোমার দু চোখ দিয়ে একদিন কতবার চেয়েছ আমারে।

আলো অন্ধকারে

তোমার পায়ের শব্দ কতবার শুনিয়াছি আমি!

নিকটে নিকটে আমি ছিলাম তোমার তবু সেইদিন —

আজ রাত্রে আসিয়াছি নামি

এই দূর সমুদ্রের জলে!

যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!

সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে

বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে

সমুদ্রের জলে,

নক্ষত্রের তলে!

রাত্রে, অন্ধকারে!

তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি,

আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

 

*

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর, মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন।

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌দিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন

চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে

কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে

কত দেহ এল, গেল — হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে

দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে

নক্ষত্রের তলে

বসে আছি — সমুদ্রের জলে

দেহ ধুয়ে নিয়া

তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।