মাধো (কবিতা) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Madho poem by Rabindranath

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

রায়বাহাদুর কিষনলালের স্যাকরা জগন্নাথ,

সোনারুপোর সকল কাজে নিপুণ তাহার হাত।

আপন বিদ্যা শিখিয়ে মানুষ করবে ছেলেটাকে

এই আশাতে সময় পেলেই ধরে আনত তাকে;

বসিয়ে রাখত চোখের সামনে, জোগান দেবার কাজে

লাগিয়ে দিত যখন তখন; আবার মাঝে মাঝে

ছোটো মেয়ের পুতুল-খেলার গয়না গড়াবার

ফরমাশেতে খাটিয়ে নিত; আগুন ধরাবার

সোনা গলাবার কর্মে একটুখানি ভুলে

চড়চাপড়টা পড়ত পিঠে, টান লাগাত চুলে।

সুযোগ পেলেই পালিয়ে বেড়ায় মাধো যে কোন্‌খানে

ঘরের লোকে খুঁজে ফেরে বৃথাই সন্ধানে।

শহরতলির বাইরে আছে দিঘি সাবেককেলে

সেইখানে সে জোটায় যত লক্ষ্মীছাড়া ছেলে।

গুলিডাণ্ডা খেলা ছিল, দোলনা ছিল গাছে,

জানা ছিল যেথায় যত ফলের বাগান আছে।

মাছ ধরবার ছিপ বানাত, সিসুডালের ছড়ি;

টাট্টুঘোড়ার পিঠে চড়ে ছোটাত দড়্‌বড়ি।

কুকুরটা তার সঙ্গে থাকত, নাম ছিল তার বটু–

গিরগিটি আর কাঠবেড়ালি তাড়িয়ে ফেরায় পটু।

শালিখপাখির মহলেতে মাধোর ছিল যশ,

ছাতুর গুলি ছড়িয়ে দিয়ে করত তাদের বশ।

বেগার দেওয়ার কাজে পাড়ায় ছিল না তার মতো,

বাপের শিক্ষানবিশিতেই কুঁড়েমি তার যত।

বড়োলোকের ছেলে ব’লে গুমর ছিল মনে,

অত্যাচারে তারই প্রমাণ দিত সকলখনে।

বটুর হবে সাঁতারখেলা, বটু চলছে ঘাটে,

এসেছে যেই দুলালচাঁদের গোলা খেলার মাঠে

অকারণে চাবুক নিয়ে দুলাল এল তেড়ে;

মাধো বললে, “মারলে কুকুর ফেলব তোমায় পেড়ে।”

উঁচিয়ে চাবুক দুলাল এল, মানল নাকো মানা,

চাবুক কেড়ে নিয়ে মাধো করলে দুতিনখানা।

দাঁড়িয়ে রইল মাধো, রাগে কাঁপছে থরোথরো,

বললে, “দেখব সাধ্য তোমার, কী করবে তা করো।”

দুলাল ছিল বিষম ভীতু, বেগ শুধু তার পায়ে;

নামের জোরেই জোর ছিল তার, জোর ছিল না গায়ে।

 

 

দশবিশজন লোক লাগিয়ে বাপ আনলে ধরে,

মাধোকে এক খাটের খুরোয় বাঁধল কষে জোরে।

বললে, “জানিসনেকো বেটা, কাহার অন্ন ধারিস,

এত বড়ো বুকের পাটা, মনিবকে তুই মারিস।

আজ বিকালে হাটের মধ্যে হিঁচড়ে নিয়ে তোকে,

দুলাল স্বয়ং মারবে চাবুক, দেখবে সকল লোকে।”

মনিববাড়ির পেয়াদা এল দিন হল যেই শেষ।

দেখলে দড়ি আছে পড়ি, মাধো নিরুদ্দেশ।

মাকে শুধায়, “এ কী কাণ্ড।” মা শুনে কয়, “নিজে

আপন হাতে বাঁধন তাহার আমিই খুলেছি যে।

মাধো চাইল চলে যেতে; আমি বললেম, যেয়ো,

এমন অপমানের চেয়ে মরণ ভালো সেও।”

স্বামীর ‘পরে হানল দৃষ্টি দারুণ অবজ্ঞার;

বললে, “তোমার গোলামিতে ধিক্‌ সহস্রবার।”

ছেলে মেয়ে চলল বেড়ে, হল সে সংসারী;

কোন্‌খানে এক পাটকলে সে করতেছে সর্দারি।

এমন সময় নরম যখন হল পাটের বাজার

মাইনে ওদের কমিয়ে দিতেই, মজুর হাজার হাজার

ধর্মঘটে বাঁধল কোমর; সাহেব দিল ডাক;

বললে, “মাধো, ভয় নেই তোর, আলগোছে তুই থাক্‌।

দলের সঙ্গে যোগ দিলে শেষ মরবি-যে মার খেয়ে।”

মাধো বললে, “মরাই ভালো এ বেইমানির চেয়ে।”

শেষপালাতে পুলিশ নামল, চলল গুঁতোগাঁতা;

কারো পড়ল হাতে বেড়ি, কারো ভাঙল মাথা।

মাধো বললে, “সাহেব, আমি বিদায় নিলেম কাজে,

অপমানের অন্ন আমার সহ্য হবে না যে।”

চলল সেথায় যে-দেশ থেকে দেশ গেছে তার মুছে,

মা মরেছে, বাপ মরেছে, বাঁধন গেছে ঘুচে।

পথে বাহির হল ওরা ভরসা বুকে আঁটি,

ছেঁড়া শিকড় পাবে কি আর পুরোনো তার মাটি।

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।