আমরা (বাঙালি) কবিতা – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে
আমরা বাঙালী বাস করি সেই তীর্থে- বরদ বঙ্গে,
বাম হাতে যার কমলার ফুল, ডাহিনে মধুর-মালা,
ভালে কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুট, কিরণে ভূবন আলো,
কোল ভরা যার কনক ধান্য, বুকভরা যার স্নেহ,
চরণ পদ্ম, অতসী অপরাজিতায় ভূষিত দেহ,
সাগর যাহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গ ভঙ্গে,
আমরা বাঙালী বাস করি সেই বাঞ্চিত ভূমি বঙ্গে।
বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি,
আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরি মাথায় নাচি।
আমাদের সেনা যুদ্ধ করেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে,
দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে।
আমাদের ছেলে বিজয়সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়
সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়।
একহাতে মোরা মগের রুখেছি, মোগলের আর হাতে,
চাঁদ-প্রতাপের হুকুমে হঠিতে হয়েছে দিল্লীনাথে।
জ্ঞানের নিধান আদিবিদ্বান কপিল সাঙ্খ্যকার
এই বাঙ্গলার মাটিতে গাঁথিল সূত্রে হীরক-হার।
বাঙালী অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ঙ্কর,
জ্বালিল জ্ঞানের দীপ তিব্বতে বাঙালী দীপঙ্কর।
কিশোর বয়সে পক্ষধরের পক্ষশাতন করি,
বাঙালীর ছেলে ফিরে এল দেশে যশোর মুকুট পরি।
বাংলার রবি জয়দেব কবি কান্ত কোমল পদে
করেছে সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চন-কোকনদে।
স্থপতি মোদের স্থাপনা করেছে ‘বরভূদরের’ ভিত্তি,
শ্যাম কাম্বোজে ‘ওস্কার-ধাম’, -মোদেরি প্রাচীন কীর্তি।
ধেয়ানের ধনে মূর্তি দিয়েছে আমাদের ভাস্কর
বিট পাল আর ধীমান,- যাদের নাম অবিনশ্বর।
আমাদেরি কোন সুপটু পটুয়া লীলায়িত তুলিকায়
আমাদের পট অক্ষয় করে রেখেছে অজন্তায়।
কীর্তনে আর বাউলের গানে আমরা দিয়েছি খুলি
মনের গোপনে নিভৃত ভুবনে দ্বার ছিল যতগুলি।
মন্বন্তরে মরি নি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি,
বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশীষে অমৃতের টিকা পরি।
দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি, আকাশে প্রদীপ জ্বালি,
আমাদেরি এই কুটীরে দেখেছি মানুষের ঠাকুরালি,
ঘরের ছেলের চক্ষে দেখেছি বিশ্বভূপের ছায়া,
বাঙালীর হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া।
বীর সন্ন্যাসী বিবেকের বাণী ছটেছে জগৎময়,
বাঙালীর ছেলে ব্যাঘ্রে বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়।
তপের প্রভাবে বাঙালী সাধক জড়ের পেয়েছে সাড়া,
আমাদের এই নবীন সাধনা শব-সাধনার বাড়া।
বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালী দিয়েছে বিয়া,
মোদের নব্য রসায়ন শুধু গরমিলে মিলাইয়া।
বাঙালীর কবি গাহিছে জগতে মহামিলনের গান,
বিফল নহে এ বাঙালী জনম, বিফল নহে এ প্রাণ।
ভবিষ্যতের পানে মোরা চাই আশাভরা আহ্বাদে,
বিধাতার কাজ সাধিবে বাঙালী ধাতার আশির্বাদে।
বেতালের মুখে প্রশ্ন যে ছিল আমরা নিয়েছি কেড়ে,
জবাব দিয়েছি জগতের আগে ভাবনা ও ভয় ছেড়ে,
বাঁচিয়া গিয়েছি সত্যের লাগি সর্ব করিয়া পণ,
সত্যে প্রণমি থেমেছে মনের অকারণ স্পন্দন।
সাধনা ফলেছে, প্রাণ পাওয়া গেছে জগত-প্রাণের হাটে,
সাগরের হাওয়া নিয়ে নিশ্বাসে গম্ভীরা নিশি কাটে,
শ্মশানের বুকে আমরা রোপণ করেছি পঞ্চবটী,
তাহারি ছায়ায় আমরা মিলাব জগতের শত কোটী।
মণি অতুলন ছিল যে গোপন সৃজনের শতদলে,
ভবিষ্যতের অমর সে বীজ আমাদেরি করতলে,
অতীতে যাহার হয়েছে সূচনা সে ঘটনা হবে হবে,
বিধাতার বরে ভরিবে ভূবন বাঙালীর গৌরবে।
প্রতিভার তপে সে ঘটনা হবে, লাগিবে না দ্বেষাদ্বেষি,
মিলনের মহামন্ত্রে মানবে দীক্ষিত করি ধীরে—
মুক্ত হইব দেব-ঋণে মোরা মুক্তবেণীর তীরে।