মাঠের গল্প (কবিতা) – জীবনানন্দ দাশ

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

মেঠো চাঁদ

মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে

আমার মুখের দিকে, ডাইনে আর বাঁয়ে

পোড়ো জমি—খড়—নাডা—মাঠের ফাটল,

শিশিরের জল।

মেঠো চাঁদ—কাস্তের মতো বাঁকা, চোখা—

চেয়ে আছে; এমনি সে তাকায়েছে কতো রাত—নাই লেখা-জোখা।

 

মেঠো চাঁদ বলে:

‘আকাশের তলে

খেতে-খেতে লাঙলের ধার

মুছে গেছে—ফসল-কাটার

সময় আসিয়া গেছে—চ’লে গেছে কবে!

শস্য ফলিয়া গেছে—তুমি কেন তবে

রয়েছো দাঁড়ায়ে

এক-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে

খড়-নাড়া—পোড়ো জমি—মাঠের ফাটল,

শিশিরের জল!’ …..

আমি তারে বলি:

‘ফসল গিয়েছে ঢের ফলি,

শস্য গিয়েছে ঝ’রে কতো—

বুড়ো হ’য়ে গেছ তুমি এই বুড়ী পৃথিবীর মতো!

খেতে-খেতে লাঙলের ধার

মুছে গেছে কতোবার—কতোবার ফসল-কাটার

সময় আসিয়া গেছে, চ’লে গেছে কবে!

শস্য ফলিযা গেছে—তুমি কেন তবে

রয়েছো দাঁড়ায়ে

একা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে

পোড়ো জমি—খড়-নাড়া—মাঠের ফাটল,

শিশিরের জল!’

 

 

পেঁচা

প্রথম ফসল গেছে ঘরে—

হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে

শুধু শিশিরের জল;

অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে

হিম হ’য়ে আসে

 

বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা;

বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা;

ধানখেতে—মাঠে

জমিছে ধোঁয়াটে

ধারালো কুয়াশা;

ঘরে গেছে চাষা;

ঝিমায়েছে এ-পৃথিবী—

তবু পাই টের

কার যেন দুটো চোখে নাই এ-ঘুমের

কোনো সাধ।

হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে,

শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে,

পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,

ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে

মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে

জাগে এক অঘ্রাণের রাতে

সেই পাখি;

 

আজ মনে পড়ে

সেদিনও এমনি গেছে ঘরে

প্রথম ফসল;

মাঠে-মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর,

কার্তিক কি অঘ্রাণের রাত্রির দুপুর;

হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে,

শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে,

পাথার ছায়ায় শাখা ঢেকে,

ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে,

মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে

জেগেছিলো অঘ্রাণের রাতে

এই পাখি।

 

নদীটির শ্বাসে

সে-রাতেও হিম হ’য়ে আসে

বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা,

বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা;

ধানখেতে মাঠে

জমিছে ধোঁয়াটে

ধারালো কুয়াশা,

ঘরে গেছে চাষা;

ঝিমায়েছে এ-পৃথিবী,

তবু আমি পেয়েছি যে টের

কার যেন দুটো চোখে নাই এ-ঘুমের

কোনো সাধ।

 

 

পঁচিশ বছর পরে

শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে—

বলিলাম—‘একদিন এমন সময়

আবার আসিও তুমি—আসিবার ইচ্ছা যদি হয়—

পঁচিশ বছর পরে।’

এই ব’লে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে;

তারপর, কতোবার চাঁদ আর তারা

মাঠে-মাঠে ম’রে গেল, ইঁদুর-পেঁচারা

জ্যোৎস্নায় ধানখেত খুঁজে

এলো গেল; চোখ বুজে

কতোবার ডানে আর বাঁয়ে

পড়িল ঘুমায়ে

কতো-কেউ; রহিলাম জেগে

আমি একা; নক্ষত্র যে-বেগে

ছুটিছে আকাশে

তার চেয়ে আগে চ’লে আসে

 

যদিও সময়,

পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!

 

তারপর—একদিন

আবার হলদে তৃণ

ভ’রে আছে মাঠে,

পাতায়, শুকনো ডাঁটে

ভাসিছে কুয়াশা

দিকে-দিকে, চড়ুয়ের ভাঙা বাসা

শিশিরে গিয়েছে ভিজে—পথের উপর

পাখির ডিমের খোলা, ঠাণ্ডা—কড়্‌কড়্‌;

শসাফুল—দু-একটা নষ্ট শাদা শসা,

মাকড়ের ছেঁড়া জাল—শুক্‌নো মাকড়সা

লতায়—পাতায়;

ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে পথ চেনা যায়;

দেখা যায় কয়েকটা তারা

হিম আকাশের গায়—ইঁদুর-পেঁচারা

ঘুরে যায় মাঠে-মাঠে, খুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজো মেটে,

পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!

 

 

কার্তিক মাঠের চাঁদ

জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ—

পাহাড়ের মতো ওই মেঘ

সঙ্গে ল’য়ে আসে

মাঝরাতে কিংবা শেষরাতের আকাশে

যখন তোমারে,

—মৃত সে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিলো যারে;

ছেঁড়া-ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে

তরাসে ছেলের মতো—আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে

 

অনেক সময়—

তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে—চাঁদ;

পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়,

একদিন হয়েছে যা—তারপর হাতছাড়া হ’য়ে

হারায়ে ফুরায়ে গেছে—আজো তুমি তার স্বাদ ল’য়ে

আর-একবার তবু দাঁড়ায়েছো এসে!

নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চারদিকে,

শস্যের খেত চ’ষে-চ’ষে

গেছে চাষা চ’লে;

তাদের মাটির গল্প—তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে

অনেক তবুও থাকে বাকি—

তুমি জানো—এ-পৃথিবী আজ জানে তা কি!

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।