Amar RabindraNath kobita lyrics আমার রবীন্দ্রনাথ – শুভ দাশগুপ্ত
পরমারাধ্য কবিবরেষু,
মাননীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহোদয়,
ধরা-ছোঁয়ার অনেক উর্দ্ধে এখন আপনি।
আমাদের জীবনের প্রত্যহিকতায়,
কলকাতা কিংবা বোলপুরের শান্তিনিকেতনে,
ইংল্যান্ডে কিংবা মংপুতে, কোথাও আর আপনার
মানবিক চলাফেরার চিহ্নটুকুও নেই।
যে মানচিত্রকে আপনি ভারতবর্ষ বলে দেখেছিলেন
আপনার প্রস্থানপর্বের অনতিবিলম্বে সে মানচিত্র
বদলে গেছে অনেকখানি।
পাঞ্জাব সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠার সিন্ধু
এখন পরদেশ,
সেখানে যেতে গেলে এখন পাসপোর্ট লাগে।
মান্য কবিবর,
সেই বদলে যাওয়া মানচিত্রের রক্তাক্ত পটভূমিতে
দাঁড়িয়ে আমি একজন সামান্য মেয়ে।
আমাদের মতো মেয়েদের জীবনে আপনি এক
আশ্চর্য স্বপ্নময় দ্বীপভূমি।
যেখানে যাবার স্বপ্ন আমাদের উদ্দীপ্ত করে,
আর যেখানে পৌঁছতে না পারার চিরকালীন গ্লানি
আমাদের বিদীর্ণ করে, বিদ্ধ করে।
দেশভাগের মর্মান্তিক যন্ত্রণা কে সম্পত্তি করে
আমাদের ধ্বস্ত পরিবার একদিন এসে বাসা বেঁধেছিলো
টালির ঘরে, শহর থেকে বহুদূরের গ্রামে।
বাবা কখনো দোকানদারী, কখন ছাত্র-পড়ানো,
কখনো এটা-সেটা ক’রে প্রখর জীবনস্রোতে
বৌ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে আজীবন চেষ্টা করেছেন
ভেসে থাকতে, বেঁচে থাকতে।
তাঁর সম্বল বলতে কিছু ছিল না,
না টাকা-পয়সা, না আশা-ভরসা,
ছিল সাহস, আর ছিলেন আপনি।
হ্যাঁ, উঠতে-বসতে চলতে-ফিরতে
কথায়-কথায় বাবা বলতেন আপনার কথা,
আপনার কবিতা আর গানের কথা,
আপনার নোবেল প্রাইজ পাওয়ার কথা,
আপনার নাইটহুড ত্যাগের কথা,
আপানার গোরা-চোখের বালি-যোগাযোগের কথা,
গীতাঞ্জলী-ছিন্নপত্রের কথা।
আর এসব কথা যখন বলতেন
দারিদ্রলাঞ্ছিত সেই দীনহীন মানুষটির
সমস্ত চোখ মুখ ভ’রে জ্বলে উঠতো আলো।
আমরা যারা শুনতাম – আমি,দাদা, মা,
আমাদের দৃষ্টির চেনা পরিধির সীমা ডিঙিয়ে
অসীম এক আকাশ উঠতো জেগে,
যে উদার নীলিমায় কেবল গান, কেবল ছবি, কেবল প্রশান্তি।
দারিদ্র আর অসাফল্যের টানাপোড়েনে বোনা
আমাদের উদ্বাস্তু জীবনে আপনি ছিলেন
এক অশেষ মাধুরী।
কবি, আপনার জানার কথা নয়, আমরা জানি,
আমরা, দেখেছি অনটন আর নিরুপায় দারিদ্র
কি ভয়ঙ্কর আগ্নেয় শক্তিতে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে
আমাদের নিরন্ন জীবনকে।
তবু যখন দিনগত পাপক্ষয়ের উপান্তে এসে
একটুখানি মাটির দাওয়ায় বাবা বসতেন
চৈত্রের সন্ধ্যার বাতাস কপালে নিয়ে,
তখন নুয়ে-পড়া দুমড়ে-যাওয়া সেই হতমান মানুষটি
কি বিশ্বাসে যে গেয়ে উঠতেন –
“নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার।”
গাইতেন, আর তাঁর গাল বেয়ে নেমে আসত
ব্যথার পরশ-লাগা অশ্রুধারা।
সব হারিয়েও বাবার বুক জুড়ে ছিলেন আপনি,
আমরা তখন অবোধ শিশু।
সেদিন ছিল শ্রাবণের এক অবিরাম বৃষ্টির রাত,
আমাদের ভাঙা ঘরের চাল ফুটো
হয়ে ঝরছিল স্রোতধারা,
আকাশে সেদিন ঘন দুর্যোগ।
মাত্র সাতদিনের জ্বরে আমার বিদ্ধস্ত মা
তখন শেষ পথের যাত্রী।
জ্বরে পুড়ে-যাওয়া মায়ের গায়ে বাবা
তখন হাত রেখেছেন একটু শান্তির স্পর্শ দিতে,
চোখে জল, মা বললেন – ছেলে মেয়েরা রইলো।
বলতে বলতে মা’র চোখ বন্ধ হয়ে এলো,
বাজ পড়লো কাছেই কোথাও, তীব্র আলোর ঝলক তুলে
ঘরের প্রদীপ গেলো নিভে, তারপর অন্ধকার।
প্রবল বর্ষণে ভেসে যাচ্ছে সবুজ গ্রাম
হু-হু করে বইছে ঝোড়ো মাতাল হাওয়া,
তখন সেই শ্মশানলগ্নে বাবা কাঁদছেন
আর মৃদু স্বরে আবৃত্তি করছেন –
“শেষ স্পর্শ নিয়ে যাবো যবে ধরণীর
বলে যাবো তোমার ধূলির তিলক পরেছি ভালে
দেখেছি নিত্যের জ্যোতি, দুর্যোগের মায়ার আড়ালে
সত্যের আনন্দ রূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মূরতি,
এই জেনে ধুলায় রাখিনু প্রণতি”।
স্বাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে অন্যরকম
হাওয়া-বাতাসে বড়ো হতে-হতে
আমার দুরন্ত দামাল দাদা
জীবনযুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিল
অল্প বয়স থেকেই।
দাদা আমার নির্ভীক কণ্ঠে গাইতো গান,
আপনারই গান,
সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর ঘরে ফিরে
দাদা এক-একদিন আমায় শোনাতে চাইতো
আপনার কবিতা।
দৃপ্ত হিরন্ময় কণ্ঠে সে আবৃত্তি করতো –
“হে সুন্দরী বসুন্ধরে, তোমাপানে চেয়ে কতবার
প্রাণ মোর উঠিয়াছে গেয়ে”।
খিদিরপুরের এক কারখানায়
দাদার সামান্য চাকরি।
শিক্ষিত এক স্বাধীন ভারতীয় যুবক
কাজ না পেয়ে দুমুঠো ভাতের আশায়
হাতুড়ি পেটাতো গনগনে বয়লারের
সামনে দাঁড়িয়ে, ঘামে ভিজে যেত তার শরীর।
তবু যখন সে মানি-অর্ডার পাঠাতো
চিলতে একটুখানি জায়গাতেও সে লিখতো –
বোন, গানটা ছাড়িস না।
গান আমার হয় নি কবি,
আসলে বেঁচে থাকাটাই হলো না ঠিকভাবে।
এখনো ছাত্র পড়াই,
টিম-টিম করে জ্বলে কেরোসিনের সান্ধ্য-আলো,
জীবন ছুটে চলেছে তার আধুনিক প্রগতির গাড়িতে চেপে,
আমি, আমরা পড়ে রয়েছি বহুদূর পথের পাশে, উপেক্ষায়।
পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে
শহরে-শহরে কত গান, কত কবিতা, কত নৃত্যনাট্য।
বড়োলোকের সুসজ্জিত ড্রইংরুমের ঝকঝকে আলমারিতে
আপনার অমূল্য রচনা সম্ভার।
তবু কবি, কেন জানি না, বার বার মনে হয়,
ওই বৈভবের হাজারদুয়ারীতে আপনি নেই,
আপনি আছেন এইখানে,
এই মর্ত্যমাটির একেবারে কাছে
সবুজে-শ্যামলে ধুলোতে-মাটিতে,
এই শীর্ণশ্রোতা নদীর ঢেউয়ে
এই ভাঙা ঘরের দরিদ্র সকালে,
এই ঝোপঝাড়ের জোনাকি ভরা
অনাড়ম্বর সন্ধ্যায়।
দশবছর কারখানা বন্ধ থাকার নিদারুণ যন্ত্রণায়
দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গিয়েছিলো
আমার দাদার সব স্বপ্ন।
ধীরে, অথচ অনিবার্যভাবে দাদা
এগিয়ে গিয়েছিলো আত্মহননের পথে।
কলকাতা থেকে যখন দাদার মৃত্যুসংবাদ এলো
ছুটে গিয়েছিলাম সেখানে,
গঙ্গার তীরবর্তী শ্মশানে দাঁড়িয়ে হু-হু করে কান্নায়
ভেসে গিয়েছিলো আমার বুক।
একা, একবারে একা মনে হয়েছিল
নিজেকে সারা পৃথিবীতে।
আর ঠিক আশ্চর্য গোধূলিলগ্নে
প্রকৃতির সবটুকু মায়াকে সাক্ষী রেখে
ওপারে দূরে বেজে উঠেছিল তোমার গান –
“ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি”।
ওমনি আমার সমস্ত অন্ধকার, সমস্ত বেদনা-গ্লানি
যেন কোথায় দূরে হারিয়ে যেতে লাগলো,
জীবনের কি এক আশ্চর্য বিশ্বাস
তখন এসে স্পর্শ করলো আমায়।
হু-হু করা করা সে সন্ধ্যায়, মনে আছে কবি,
বুকের গভীরতম অনুভব থেকে গেয়ে উঠেছিলাম –
“আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে,
দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে”।
কবি, আজও তুমি আছো, প্রতিদিন আছো
এই হতভাগ্য দেশের অগণিত মানুষের চিন্তায়-চেতনায়,
আছো প্রতিদিনের দুঃখ-সুখের ধ্বস্ত দিনলিপিতে।
পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণের শহুরে আড়ম্বরে নয়,
তুমি বেঁচে আছো, বেঁচে থাকবে চিরদিন, চিরকাল।