Chuti poem lyrics Subho Dasgupta ছুটি (কবিতা) – শুভ দাশগুপ্ত
কিছু একটা করেন স্যার আজ চারদিন হয়ে
গেল আমার ছোট্ট মেয়েটা ঐ নোংরা
বারান্দায় পড়ে আছে।
জুতার দোকানের সামান্য মাইনের কর্মাচারী নিকুঞ্জ।
তার আদরের মেয়ে মা মনির কঠিন অসুখ।
ডায়ালিসিস করতে হবে। পাড়ার এম এল এ
দয়ালু হাতে চিঠি দিয়েছেন মন্ত্রীর সি এ কে।
তিনি চিরকুট পাঠিয়েছেন আরেক আমলাকে।
আমলা নোট পাঠিয়েছেন হাসপাতালের সুপারকে।
কিন্তু গত কদিনে নিকুঞ্জের সমস্ত উদ্বেগ আর উৎকন্ঠাকে তুচ্ছ করে
সে নোট পৌছায়নি হাসপাতালে। নোট গেলে বিনা খরচে
মা মনির ডায়ালিসিস করা হবে।
গরিব নিকুঞ্জ সারাদিন দোকানে
মানুষের পায়ে জুতা পরায়।
অন্য মনস্ক কাজে ভুল হয়ে যায় বারবার
মালিক ধমক লাগায়, এক একটা নধর পায়ে জুতা পরাতে পরাতে
নিকুঞ্জের ইচ্ছা হয়, পয়সাওয়ালা খদ্দেরের পা দুটো চেপে ধরে বলেঃ
—স্যার,আমার একমাত্র মেয়ে পয়সার অভাবে
হাসপাতালের নোংরা বারান্দায় একা পড়ে রয়েছে।
তার চিকিৎসা হচ্ছে না। দিন না স্যার কয়েক হাজার টাকা।
আমি সারা জীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকবো।
দুটোর সময় ছুটি নিয়ে কলকাতার ডাকসাইটে জ্যাম ডিঙ্গিয়ে
অসংখ্য মানুষের ভীড় এড়িয়ে নিকুঞ্জ
রাইটার্সের পৌঁছায় হাঁফাতে হাফাঁতে।
কেরানী বাবুর টেবিলের সামনে দাঁড়ায় চোরের মত
বাবুর্টি বললেন
—আজ আর হবে না দাদা,
—কেন ?
—জানেন না? নাগাল্যন্ডের পশুমন্ত্রীর মৃত্যুতে
আজ আমাদের হাফ ছুটি ঘোষনা করা হয়েছে।
—ও তাহলে কাল ?
—কালও হবে না। কাগজ পড়েন না নাকি ?
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে কাল পুর্ন দিবস ছুটি।
—তাহলে পরশু ? নিকুঞ্জ ব্যস্ত হয়ে উঠে।
—পরশু শনিবার, তারপর রবিবার ,আপনি একবারে সোমবার আসুন।
সোমবার মানে আরও চারটি দিন বাকি ?
তলিয়ে যেতে থাকে নিকুঞ্জ।
যেতে যেতে তার কানে বারবার ভেসে আছে মা মনির কন্ঠস্বরঃ
বাবা আমার কবে ছুটি হবে ?
আমি কবে বাড়ি যাবো বাবা ?
হঠাৎ নিকুঞ্জর মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠে,
দুর্বল অভুক্ত শীর্ন শরীরে হঠাৎই যেন জ্বলে উঠে ভয়ংকর তেজ ।
রাইটার্সের বারান্দা দিয়ে ছুটতে থাকে নিকুঞ্জ।
আর ছুটতে ছুটতে সোজা গিয়ে নিকুঞ্জ ডুকে
ডালহাউসী পাড়ার প্রাচীন এক বন্দুকের দোকানে।
আগুন জ্বলছে তখন নিকুঞ্জুর মাথায়। ধুমকেতুর মত
নিকুঞ্জ চিৎকার করে বলতে থাকে
—আমাকে একটা বন্দুক দিন,আমাকে একটা বন্দুক দিন,
যা থেকে হাজার হাজার গুলি বের হবে।
আমি সমস্ত নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী, কর্তাদের গুলি করে মেরে ফেলব
তারপর, সারাদেশে একদিনই রাষ্ট্রীয় শোক, একদিনই ছুটি।
আর তারপর আমার মা-মনির ডায়ালিসিস।
দোকানের দারোয়ান ঘাড় ধরে নিকুঞ্জকে বের করে দেয়।
নিকুঞ্জ ছুটতে ছুটতে হাফাঁতে হাফাঁতে হাসপাতাল।
হঠাৎ ঝপ করে লোডশেডিং এর মত নিকুঞ্জ’র চোখের সামনে
সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায়। মা-মনির বিছানাটা খালি।
মা-মনি কোথায় ? কোথায় আমার মা-মনি ?
অনেক রাতে….
ভাড়া করা ম্যাটাডোরে একটা খাটিয়ায় মা-মনি কে শুইয়ে
দূর মফস্বলের বাড়ীর পথ ধরে নিকুঞ্জ।
সারাটা রাস্তা পুর্নিমার চাঁদ আলো ধরলো মা-মনির মুখে।
এক আকাশ নক্ষত্র আর তারা আলো বিছিয়ে রাখলো
মা-মনির ঘরে ফেরার পথে।
আর নিকুঞ্জ শুনতে পেল নক্ষত্র চাঁদ তারা সবাই বলছে
আমাদের ছুটি নেই নিকুঞ্জ,আমরা আলো জ্বেলে রেখেছি
তোমার মা-মনির জন্য আমরা আলো জ্বেলে রেখেছি।
ভোরের আলো তখন সবে ফুটছে।
ম্যাটাডোর ভ্যান এসে থামলো নিকুঞ্জ’র
ভাঙ্গা বাড়ীর দরজায়। নিকুঞ্জ’র বউ পাগলের মত ছুটে এল
—এনেছো? আমার মেয়েকে এনেছো?
পাথর হয়ে যাওয়া নিকুঞ্জ তুমুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে
আর বার বার বলতে লাগল
“তোমার মা-মনির ছুটি হয়ে গেছে”
“তোমার মা-মনির ছুটি হয়ে গেছে”