Shabandani poem lyrics সাবানদানি কবিতা – শুভ দাশগুপ্ত
মাকে আমি ছোটবেলা থেকেই সাদা শাড়ি পরতে দেখি।
আমার জন্মের আটমাস পরে-হঠাৎই আমার বাবা চোখ বুজেছিলেন।
সেই থেকেই মা’ মানেই সাদা শাড়ি
মা’ মানেই শিরা ওঠা হাতে দু গাছা ব্রোঞ্জের চুড়ি,
ফাঁকা কপাল, ধূ ধূ সিঁথে, চোখ জুড়ে বিকেল। শুধু বিকেল।
মা’র একটা বাক্স ছিল। একটাই সেকেলে ট্রাঙ্ক ।
মাঝে মাঝে মা যখন খুলতো বাক্সটা, ঝপ্ করে
ন্যাপথলিনের গন্ধ উঠে আসতো ভিতর থেকে।
আমি জোর করে এটা সেটা নাড়াচাড়া করে দেখতাম।
কী সুন্দর একটা সিঁদুরের কৌটো।
মা বলতো “ খুকী। তোর বিয়ের সময় তোকে দেব এটা।”
কী সুন্দর ঝলমলে একটা বেনারসী!
মা বলতো : তোর বিয়ে হলে-তখন তোকে দেব!
কী দারুণ দেখতে একটা সাবানের কেস্।
মা বলতো ! “এটা তোর বাবার …” এই বলে মা হঠাৎই
আনমনা হয়ে পড়ত। সাবানের কেসটা হাতে নিয়ে চুপ করে
কী যেন ভাবতো মা।
মা হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতো :
“হ্যাঁ মা। এ আর আমি নিয়ে কী করবো ? তোকেই দিয়ে দেব।”
একান্নবর্তী কাকা জ্যাঠার সংসারে
চোখের জলে মায়ের দিন কাটতো। লাঞ্ছনা গঞ্জনা অপমান-
এসব দিয়েই ভাত মাখতো মা।
আমার সাদা শাড়ির মা। আমার ফাঁকা কপাল ধূ ধূ সিঁথের মা।
চোখের পাওয়ারে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা বিকেল নিয়ে মা।
আমার মা
অভাগীরো মাঝে মাঝে স্বর্গলাভ হয়। আমারও বিয়ে হল।
ভাল ঘর। ভাল বর।
মামারা এসে দাঁড়িয়েছিল। কাকা জ্যাঠারা যে যার আলাদা বাড়ি করে
দূরে চলে গিয়েছিল অনেক আগেই।
বিয়ের সময়, সেলাই করে সংসার চালানো আমার মা
আমায় ট্রাঙ্কের সব কিছুই দিয়ে দিয়েছিলো :
শুধু ওই সাবানদানিটি ছাড়া।
আমিও চাইনি।
একলা ঘরে ছোট্ট তাকে-চোখের সামনেই রেখে দিয়েছিল মা
সাবানের সেই সুন্দর কেস্ টা। পাশেই মার ঠাকুরের আসন।
জামাই ষষ্ঠীর দিন দুপুরে বেদম খাওয়াদাওয়ার শেষে
খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে আরাম করে
জমিয়ে সিগারেট খাচ্ছিল আমার বর।
আমি আর মা রান্নাঘরে গল্প করছিলাম।
হঠাৎ ঘরে ঢুকে দেখি-
সাবানদানিটাকে অ্যশট্টে বানিয়ে তাতে ছাই ফেলছে ও।
আমি চকিতে ছুটে ওর কাছে গেলাম।
চিৎকার করে উঠলাম ! এ কী করেছ তুমি ?
ও অবাক হয়ে তাকিয়ে
রইল আমার দিকে।
মা ঘরে ঢুকে বললো : কী হয়েছে ? অমন চিৎকার করছিস কেন ?
তারপর দেখলো পুরো দৃশ্যটা।
আমার সাদা শাড়ির মা।
আমার ফাঁকা কপাল ধূ ধূ সিঁথের মা,
দুচোখ জোড়া হু হু বিকেল নিয়ে মা
ভাল করে দেখলো অনেকক্ষণ ধরে। তার পর বললো :
ওমা! এতে এত বকাবকির কী আছে ? যাঃ ওরকম করতে নেই।
সাবনদানিটা এবার তুই নিয়ে যাস খুকি।
ওটা তো তোকে দেবার কথাই ছিল।
যা চায়ের জলটা বসা।