Shajahan poem lyrics শাজাহান কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

Shajahan kobita poem lyrics শাজাহান কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

এ কথা জানিতে তুমি ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান,

কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান।

শুধু তব অন্তরবেদনা

চিরন্তন হয়ে থাক্, সম্রাটের ছিল এ সাধনা

রাজশক্তি বজ্রসুকঠিন

সন্ধ্যারক্তরাগসম তন্দ্রাতলে হয় হোক লীন

কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস

নিত্য-উচ্ছ্বসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ,

এই তব মনে ছিল আশ।

হীরামুক্তামানিক্যের ঘটা

যেন শুন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা

যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক,

শুধু থাক্

একবিন্দু নয়নের জল

কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল

এ তাজমহল॥

 

হায় ওরে মানবহৃদয়,

বার বার

কারো পানে ফিরে চাহিবার

নাই যে সময়,

নাই নাই।

জীবনের খরস্রোতে ভাসিছ সদাই

ভুবনের ঘাটে ঘাটে-

এক হাতে লও বোঝা, শুন্য করে দাও অন্য হাটে।

দক্ষিণের মন্ত্রগুঞ্জরণে

তব কুঞ্জবনে

বসন্তের মাধবীমঞ্জরি

যেই ক্ষণে দেয় ভরি

মালঞ্চের চঞ্চল অঞ্চল-

বিদায়গোধুলি আসে ধুলায় ছড়ায়ে ছিন্ন দল।

সময় যে নাই,

আবার শিশিররাত্রে তাই

নিকুঞ্জে ফুটায়ে তোল নব কুন্দরাজি

সাজাইতে হেমন্তের অশ্রুভরা আনন্দের সাজি।

হায় রে হৃদয়,

তোমার সঞ্চয়

দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নাই নাই, নাই যে সময়॥

 

হে সম্রাট্, তাই তব শঙ্কিত হৃদয়

চেয়েছিল করিবারে সময়ের হৃদয়হরণ

সৌন্দর্যে ভুলায়ে।

কণ্ঠে তার কী মালা দুলায়ে

করিলে বরণ

রূপহীন মরণেরে মৃত্যুহীন অপরূপ সাজে!

রহে না যে

বিলাপের অবকাশ

বারো মাস,

তাই তব অশান্ত ক্রন্দনে

চিরমৌনজাল দিয়ে বেঁধে দিলে কঠিন বন্ধনে।

জ্যোত্‍‌স্নারাতে নিভৃত মন্দিরে

প্রেয়সীরে

যে নামে ডাকিতে ধীরে ধীরে

সেই কানে-কানে ডাকা রেখে গেলে এইখানে

অনন্তের কানে।

প্রেমের করুণ কোমলতা,

ফুটিল তা

সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে॥

 

হে সম্রাট্ কবি,

এই তব হৃদয়ের ছবি,

এই তব নব মেঘদূত,

অপূর্ব অদ্ভুত

ছন্দে গানে

উঠিয়াছে অলক্ষ্যের পানে-

যেথা তব বিরহিণী প্রিয়া

রয়েছে মিশিয়া

প্রভাতের অরুণ-আভাসে,

ক্লান্তসন্ধ্যা দিগন্তের করুণ নিশ্বাসে,

পূর্ণিমায় দেহহীন চামেলীর লাবণ্যবিলাসে,

ভাষার অতীত তীরে

কাঙাল নয়ন যেথা দ্বার হতে আসে ফিরে ফিরে।

তোমার সৌন্দর্যদূত যুগ যুগ ধরি

এড়াইয়া কালের প্রহরী

চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া-

‘ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া!’

 

চলে গেছ তুমি আজ,

মহারাজ-

রাজ্য তব স্বপ্নসম গেছে ছুটে,

সিংহাসন গেছে টুটে,

তব সৈন্যদল

যাদের চরণভরে ধরণী করিত টলমল

তাহাদের স্মৃতি আজ বায়ুভরে

উড়ে যায় দিল্লির পথের ধূলি-‘পরে।

বন্দীরা গাহে না গান,

যমুনাকল্লোল-সাথে নহবত মিলায় না তান।

তব পুরসুন্দরীর নূপুরনিক্কণ

ভগ্ন প্রাসাদের কোণে

ম’রে গিয়ে ঝিল্লিস্বনে

কাঁদায় রে নিশার গগন।

তবুও তোমার দূত অমলিন,

শ্রান্তিক্লান্তিহীন,

তুচ্ছ করি রাজ্য-ভাঙাগড়া,

তুচ্ছ করি জীবনমৃত্যুর ওঠাপড়া,

যুগে যুগান্তরে

কহিতেছে একস্বরে

চিরবিরহীর বাণী নিয়া-

`ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া!’

 

মিথ্যা কথা! কে বলে যে ভোল নাই?

কে বলে রে খোল নাই

স্মৃতির পিঞ্জরদ্বার?

অতীতের চির-অস্ত-অন্ধকার

আজিও হৃদয় তব রেখেছে বাঁধিয়া?

বিস্মৃতির মুক্তিপথ দিয়া

আজিও সে হয়নি বাহির?

সমাধিমন্দির এক ঠাঁই রহে চিরস্থির,

ধরার ধূলায় থাকি

স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখে ঢাকি।

জীবনেরে কে রাখিতে পারে!

আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।

তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে

নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে।

স্মরণের গ্রন্থি টুটে

সে যে যায় ছুটে

বিশ্বপথে বন্ধনবিহীন।

মহারাজ, কোনো মহারাজ্য কোনোদিন

পারে নাই তোমারে ধরিতে।

সমুদ্রস্তনিত পৃথ্বী, হে বিরাট, তোমারে ভরিতে

নাহি পারে-

তাই এ ধরারে

জীবন-উত্‍‌সব-শেষে দুই পায়ে ঠেলে

মৃত্‍‌পাত্রের মত যাও ফেলে।

তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহত্‍‌,

তাই তব জীবনের রথ

পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার

বারম্বার।

তাই

চিহ্ন তব পড়ে আছে, তুমি হেথা নাই।

যে প্রেম সম্মুখপানে

চলিতে চালাতে নাহি জানে,

যে প্রেম পথের মধ্যে পেতেছিল নিজসিংহাসন,

তার বিলাসের সম্ভাষণ

পথের ধূলার মতো জড়ায়ে ধরেছে তব পায়ে-

 

দিয়েছ তা ধূলিরে ফিরায়ে।

সেই তব পশ্চাতের পদধূলি-‘পরে

তব চিত্ত হতে বায়ুভরে

কখন সহসা

উড়ে পড়েছিল বীজ জীবনের মাল্য হতে খসা।

তুমি চলে গেছ দূরে,

সেই বীজ অমর অঙ্কুরে

উঠেছে অম্বর-পানে,

কহিছে গম্ভীর গানে-

‘যত দূর চাই

নাই নাই সে পথিক নাই।

প্রিয়া তারে রাখিল না, রাজ্য তারে ছাড়ি দিল পথ,

রুধিল না সমুদ্র পর্বত।

     আজি তার রথ

চলিয়াছে রাত্রির আহ্বানে

     নক্ষত্রের গানে

প্রভাতের সিংহদ্বার-পানে।

তাই

স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি,

ভারমুক্ত সে এখানে নাই।’

 

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।