Shukanto Bhattacharya ke khola chithi সুকান্ত ভট্টাচার্যকে খোলা চিঠি

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

 

Shukanto Bhattacharya ke khola chithi সুকান্ত ভট্টাচার্যকে খোলা চিঠি

 

রাত্রির দ্রুতগামী অশ্বারোহীদের বলেছি

এই চিঠি তারা স্মৃতির লাল ডাকবাক্সে ফেলে দেবে।

 

রাস্তার পাশে তামাটে কলাপাতা জড়ানো দু’শো পাঁচখানা হাড়

পেটের ভারে কুঁজো হয়ে মাটিতে বাটি পেতে বসে আছে,

বাটিতে টুংটাং টুংটাং শব্দ তুলে

রোদ্দুরের মুখে জুতোর ঝিলক মেরে

পেরিয়ে গেল পকেটে-কলম-গোঁজা সময়।

 

গাঁয়ের আড় চোখ তাকানো টাউটের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে শহুরে শয়তান,

চারদিকে তালপাতার সেপাইদের কুচকাওয়াজের শব্দ

আমাদের সমস্ত গানকে গলা টিপে দেওয়ালে ঠেসে ধরেছে, এই সময়ে

তুমি যদি বেঁচে থাকতে-

আজ তোমার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হোতো।

 

পূর্ব গোলার্ধের এই উষ্ণ অঞ্চলে বার্ধক্য বড় তাড়াতাড়ি আসে,

বেঁচে থাকলে তুমি হয়ত তোমার মতোই টবগে তরুণ,

কিংবা আমাদের মত অস্পষ্টভাষী মেনিমুখো বাহাত্তুরে

হয়ে যেতে পারতে,

এখানে সকাল সন্ধ্যে টপ্ টপ্ ঘামের শব্দের মধ্যে

দু’একবার দোয়েল শিস দেয়,

ফস্ করে দেশলাই জ্বলে ওঠে, আর তখনই

দক্ষিণ বাতাসে উড়ো খবর আসে-

এখানে শোক কিংবা সুখের পরমআয়ু, এখনো,

একটা জলন্ত সিগারেটের চেয়ে বেশি নয়।

 

টিকে থাকলে হয়তো কোনো আন্তর্জাতিক লেখক সংঘের

পুরষ্কার-ঝোলানো সভাপতি-

ঘন ঘন হাওয়াই জাহাজের তলা থেকে মাটি সরে যেতো,

একাডেমির চেয়ারম্যান, পুস্তক প্রকাশনীর মালিক,

বাজারি পত্রিকার খুঁটি কিংবা রাষ্ট্রিয় পুঁজির প্রচার অধিকর্তা অথবা

আগাগোড়া খাঁটি থাকার দায়ে

চারখানা যবের ঝলসানো পূর্ণিমা চাঁদের উপর

এক হাতা আস্ত কলাইসেদ্ধ গড়িয়ে যেত-

জেলখানায়।

 

বেঁচে থাকা, বিশেষ ক’রে কলমবাজদের পক্ষে

একটা করুণ চালাকি।

টিকে থাকতে থাকতে শুধুমাত্র ‘বেঁচে থাকা’ নামক দুটো

ভালো মানুষ শব্দের জন্য জীবনের মস্ত ভারি অভিধানের পাতায় পাতায়

চোখ ঘষে ঘষে মানুষ কত কী যে হয়ে যেতে পারে……

 

তোমার শোকমিছিলে সম্ভবত চারজন লোক ছিলো,

কারন মৃতদেহ বহনের জন্য কমপক্ষে চারজনের দরকার হয়,

আর যাদের থাকার কথা ছিলো—

তারা তখন কারখানায় বয়লারের সামনে

খনির অন্ধকারের মালিকানায় শাবলের ধাতব সংঘর্ষে

ভাঙা খোয়ার পাহাড়ের সামনে রাস্তার ধারে গাছতলায়

জলন্ত ইটের পাঁজার কাছাকাছি,

গোড়ালি-ফাটা মাঠে তেষ্টার লম্বা দরখাস্ত মেলে-দেওয়া

জিভের উপর

কর্কটক্রান্তির চামড়া-পোড়ানো আঁচের নিচে পিঠ পেতে

গামছা দিয়ে বার বার গায়ের ঘাম মুছে নিচ্ছিলো ।

 

না তারা তোমার কথা জানতো না। কারণ,

তাদের কাছে তোমার লেখা পৌঁছোয়নি, কারণ

তাদের অক্ষর-পরিচয় ঘটেনি।

 

তাই এখন আমরা আমাদের নিরক্ষর বিবেকের সামনে

হিতৈষী খাদির পর্দা ঝুলিয়ে দিয়ে

তাদের স্বাক্ষর বানাবার তালে আছি। যাতে

অন্তত এই ভুবনবিজয়ী লঙ্গরখানার নামের দীর্ঘতম তালিকায়

তারা নিজের নামটা পড়ে নিতে পারে।

 

মৃত ব্যক্তির কাছে চিঠি লেখার কোন মানে হয় না, জানি।

কিন্তু তুমি তো ব্যক্তি নও, প্রতিষ্ঠান নও, তুমি একটা শ্রেনী-

একটা সর্বগ্রাসী ঘামে-ভেজা লেলিহান অগ্রগামী শ্রেনীগত মানুষ – তুমি,

তাই রাত্রির দ্রুতগামী অশ্বারোহীদের বলেছি

তারা যেন একবার অন্ধকার দিগন্তে নক্ষত্রভেদী বর্শা এবং

মশাল নামিয়ে রেখে এই চিঠি স্মৃতির গোপন লাল ডাকবাক্সে ফেলে দেয়।

 

টি বি-তে তোমার ফুসফুস ঝরঝরে হয়ে গিয়েছিলো,

এদেশে লক্ষ লক্ষ লোকের যায়,

তোমাকে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে ঘরে বাইরে যক্ষ্মার জীবাণুদের বিরুদ্ধে

লড়তে হয়েছিলো; এদেশে এরকম সংগ্রামীর সংখ্যা কম নয়,

তুমি এক সময় ঠোটের রক্তে-ভেজা গান গাইতে গাইতে

আগুনের পাখি হয়ে ভোরের পাহাড় থেকে দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে চলে গেলে

এরকম সকলের ক্ষেত্রে হয় না। আর, সেখানেই তুমি

আমাদের প্রানের সঙ্গী, আমাদের কুড়ে-খাওয়া স্মৃতি,

আমাদের আগামী বিবেক, আমাদের কাপুরুষ পাঁজরের নিচে

তুমি একটা গনগনে গানের মধুরতম সন্ত্রাস।

 

ফুটপাতে বসে থাকা ঐ ভিখিরি মেয়েটির সামনে চুরুট মুখে

শলা পরামর্শ করতে করতে পাল্টে যাচ্ছে সময়।

উপর থেকে নিচের দিকে ছেঁড়া কাপড়, এক টুকরো ক্ষয়ে যাওয়া সাবান,

দু’খানা বাসি রুটি ছুড়ে দিয়ে বিশাল ঘোড়ালে জালে তুলে নিচ্ছে

গায়ের রক্ত-জল-করা রুপালি শস্য-

এখন জন্মান্ধের ঘষা চোখের মতো সূর্য পশ্চিম সমুদ্রে নেমে গেল

গায়ে দু’তিনটে গোল ছিদ্র নিয়ে তরুণ – মড়ার খুলির মতো

চাঁদ উঠে আসে,

তোমার রানার এখন আর ঝুম্ ঝুম্ ঘন্টা বাজায় না,

তালিমারা ছাতা মাথায় কাঁধের ঝোলা থেকে ঊনত্রিশটা

আত্মহত্যার খবর আর অগুনতি বরখাস্তের চিঠি বিলি করে বেড়ায়—

আর রাত্রে হাঁপানির টানের সঙ্গে কপালের নিচে দুটো গভীর গর্ত থেকে

ঠিকরে বেরিয়ে আসে লাল্‌চে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-

গলায় মাদুলি হয়ে ঝুলে থাকে এশিয়ার দীর্ঘতম রাত্রি।

 

তুমি যে ভরপুর প্রাণের আবেগে লেনিন হ’তে চেয়েছিলে—

সেই তাঁকে নিয়েও এখন ভাগ-বাঁটোয়ারা চলেঃ ফলে—

ভাগের মা গঙ্গা পায় না।

একথা তো তুমি পরিষ্কার জানতে

এই কোটি কোটি পিছু-মোড়া-হাত-পা-বাঁধা ক্রীতদাসের বাজারে

সব কিছুই পণ্য-

এই মৌসুমী অঞ্চলের ফুল ও ফল,

ঐ বাতাসা হাতে ছুটন্ত শিশুটির চিবুকের তিল,

এই জবরদস্তি জীবনের সমস্ত লবঙ্গ ও এলাচ

ঐ রোদে – পোড়া ফুটপাতে ডানহাতের আঙুলকাটা আসন্নপ্রসবা

ভিখিরি মেয়েটির চিত্রকল্প,

নিঃস্বের ন্যাকড়া কিংবা পণ্ডিতের মগজ,

এমনকি তোমার জন্মদিনও

পণ্য।

 

আর এই মাল খালাস-করা বেনিয়া, মাতাল, ধড়িবাজ, গুপ্তচর এবং

ফড়েদের ভীড় এবং তোমার জন্য লোক দেখানো হা-হুতাস

এসবের বাইরে একজন আমাদের জন্য ঘোরতর অপেক্ষা করে আছে,

সে সবেমাত্র ভুমিষ্ঠ হয়েছে,

যদিও আমরা তাকে, নিজেদের মধ্যে চোখ টেপাটেপি করে,

তোমার জন্ম-জয়ন্তির কমিটির সদস্য ক’রে নেবার ফিকিরে আছি

সে কিন্তু আমাদের কাউকেই পেয়ারের লোক ব’লে খাতির করবে না,

কারণ আমরা তার মা-কে ফুটপাতে শুকিয়েছি—

আমরা তার হাতে তোবড়ানো এনামেলের বাটি ধরিয়ে দিয়েছি এবং

জন্মের পরে শুকনো মায়ের ঝুলন্ত বুক চুষে

দুধের পরিবর্তে কয়েক ফোঁটা রক্ত চেটে নিয়েছে এই সদ্যোজাত

উলঙ্গ, আগামী ভারতবর্ষ।

আর তাই যখন এই উপমহাদেশ জোড়া বিশাল ডালপালা ছড়ানো

প্রানময় গাছটিকে দুই প্রান্ত থেকে দেশি এবং বিদেশি হাতল লাগানো

করাতে চিরে রস গড়িয়ে-পড়া ফালিগুলো দুই দিকে জমা করছে, আর,

মধ্যবর্তী বধ্যভূমিতে

ফিন্কি দিচ্ছে দিন এবং রাত্রির অগ্নিকনা— এই সুসময়ে

তোমার কথাই মনে পড়ে, একমাত্র তোমার কথা-

তাই রাত্রির দ্রুতগামী অশ্বারোহীদের বলেছি

অন্ধকারের সমস্ত আশ্রয় পুড়িয়ে দেবার আগে,

সমস্ত পাহাড় আর সমুদ্রের উপর হাজার হাজার পাখি উড়িয়ে দেবার আগে,

এই চিঠি যেন তারা তোমার ফুসফুস-ক্ষরিত ভোরের

লাল ডাকবাক্সে ফেলে দেয়।

 

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।