Korno kobita poem lyrics Sabyasachi Deb কর্ণ কবিতা – সব্যসাচী দেব
তাহলে সময়, অর্জুন!
দ্বৈরথ সমর,
উত্তর-ভূখণ্ড জুড়ে পরমায়ু হন্তারক ছায়া,
বুকের নিভৃত থেকে উঠে আসে অরণ্য-পিপাসা,
সমস্ত শিকড় জুড়ে প্রতিহিংসা ঢালে বিষ ;
এতদিনে অর্জুন, এতদিনে
মুখোমুখি তোমাতে আমাতে।
তিলে তিলে শোধ করছি অযাচিত জন্মের ঋণ,
আশৈশব আকাঙ্ক্ষার ভেলা বেয়েছি উজানে,
আজ সেই ধ্রুব-লগ্ন ;
দেখো, এই মধ্যদিনে কনিষ্ঠ আঙুলে আমি ধরে রাখি সমস্ত পৃথিবী,
নেই একাঘ্নী আয়ুধ, কবচ-কুণ্ডল হৃত ছদ্মবেশী ভিক্ষুকের হাতে,
আর নেই, এমনকী জীবনেরও নেশা
বিলিয়ে দিয়েছি তা গত গোধূলিতে ;
অস্তমান সূর্যকে ঢেকে, আমার সামনে এসে
মাতা কুন্তী ভিক্ষা চাইলেন পঞ্চপুত্রের প্রাণ,
তাঁর চোখের মিনতি তোমারই জন্য হে অর্জুন ;
সেই মুহূর্তে জানলাম, যদি জয়ী হই সমস্তজীবন
আমাকে বহন করতে হবে অভিশাপ – আমার মাতার ;
এইবার লগ্ন এল, তৃতীয় পাণ্ডব। শেষ খেলা ;
বাজি রইল যে-কোনো জীবন, ধনুর্বাণ হাতে নাও,
এ খেলায় পরিত্রাণ নেই কোনো, কারো নেই তোমার আমার।
আমাকে একমুহূর্তে ভিক্ষা দাও কৌন্তেয় ;
সারা শরীর ভারি হয়ে আসছে পাথরের মতো
বড়ো দীর্ঘকাল রণক্ষেত্রে আছি।
সমবেত জনতার অট্টহাসি, আচার্যের প্রত্যাখ্যান, তোমার বঙ্কিম বিদ্রুপ,
এর মাঝে তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম আমি ক্রীড়াঙ্গনে
জানতাম আমার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই ভারতভূমিতে তুমি ছাড়া ;
প্রবল স্পর্ধায় ছুঁড়ে দিয়েছিলাম দ্বন্দ্বের আহ্বান,
কিন্তু বিনা যুদ্ধে তুমি অর্জন করে নিলে শ্রেষ্ঠত্বের বরমাল্য ;
আরো একবার, কাঙ্ক্ষিতা নারীকেও তুমি জিতে নিয়েছিলে
আমার অবনত দৃষ্টির সামনে থেকে,
অসিতাঙ্গী অগ্নিকন্যা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন
সুতপুত্রকে বরণ করার অনিচ্ছায় ;
তবু স্থির করি নি আমার পথ,
বারেবারে আমাকে মনে করিয়ে দেওয়ে হয়েছে আমি সুতপুত্র
বারেবারে আমি ভুলতে চেয়েছি সেই পরিচয় ;
অধিরথ দিয়েছিলেন স্নেহ ; সামান্যা নারী রাধা
আমাকে পূর্ণ করেছিলেন মাতৃত্বের অমৃতে
আর প্রতিমুহূর্তে সেই ভালোবাসা আস্বাদন করতে করতে
আমি ভেবেছি এখানে নয়, আমার স্থান পাণ্ডু-রাজ গৃহে ;
যা-কিছু আমার আকাঙ্ক্ষা, তাই আমাকে অর্জন করতে হয়েছে
মিথ্যার আড়ালে। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পেয়েছি শস্ত্রজ্ঞান,
বিদ্রপের প্রতিবাদে বজ্রমুষ্টি তুলে ছেড়ে আসি নি ক্রীড়াভূমি,
দুর্যোধনের অনুগ্রহ বরণ করে, আত্মবঞ্চনার মোহে নিজেকে ভুলিয়ে
বসেছি ছদ্ম-ক্ষত্রিয়ের সিংহাসনে।
আর বিনিময়ে বিলিয়ে দিয়েছি আমার স্বাধীনতা।
বিশাল সভাগৃহে দুঃশাসনের লোলুপ আঙুল
যখন ছিড়ে নিচ্ছিল দ্রৌপদীর লজ্জা
ক্ষণিকের জন্য আমার তূণীর থেকে তীর উঠে এসেছিল হাতে
আমার কাঙ্ক্ষিতার অপমানে –
পরক্ষণেই করতালিতে ব্যস্ত হয়েছে দু-হাত ;
কেননা দুর্যোধন আমার উপকারী বান্ধব, আমার প্রভু।
প্রতিমুহূর্তে দুর্যোধনের ভ্রুকুটি স্থির করে দিচ্ছিল আমার কর্তব্য
আর প্রতিমুহূর্তে নিজের অক্ষম ভীরুতাকে ঢেকে রাখার জন্য
উচ্চরবে প্রচার করেছি আমার শৌর্যের অহংকার।
তারপর এল এই মহালগ্ন। প্রত্যাবর্তনের কোনো পথ নেই ;
দুইপক্ষ ভারতসমরে, একদিকে আমার অন্নদাতা, অন্যপক্ষে
আমার মাতার পঞ্চপুত্র। মাঝখানে আমি সুতপুত্র
রাধার সন্তান, কেউ নই যুযুধান শিবিরের, অন্নের দাসত্ব
তবু টান দেয় স্বেচ্ছাবৃত শৃঙ্খলের পাকে।
রণক্ষেত্র থেকে দূরে, ভাঙা কুটিরে, শুধু দীর্ঘশ্বাস
ফেলে যায় এক নারী, যার নাম রাধা,
যার স্বামী সামান্যই রথের সারথি।
মাঝেমাঝে সেই দীর্ঘশ্বাস আমাকে ছুঁয়েছে ; ভেবেছি তা বুঝি
উত্তরের হিমেল বাতাস। কানে ভেসে এসেছে মৃদু কান্নার শব্দ,
ভেবেছি তা বুঝি দূর দক্ষিণ-সমুত্রের তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস।
আর প্রতি সন্ধ্যায়
সূর্যবন্দনার ছলে নামিয়ে রাখতে চেয়েছি
আমার অপরাধের ভার ;
চারপাশে গাঢ় হয়ে নেমেছে
শ্মশানের ছায়া ;
ফিরি নি তবুও যেখানে স্বদেশ।
কেউ নেই আত্মীয়-বান্ধব, তাদের ফিরিয়েছি নিজে
পরিবর্তে চেয়েছি কৌরব-সম্মান,
যে ছিল স্বজন, রূঢ় অস্বীকারে বিমুখ করেছি তাকে
ভুলেছি স্বস্থান ;
আমি ভুলেছিলাম, তাই এই মুহূর্তে আমাকেও ত্যাগ করল
আমার অভ্যস্ত বিদ্যা, আজন্ম-লালিত অস্ত্রজ্ঞান ;
অর্জুন, মেদিনী নয়, রথচক্র গ্রাস করছে আমারই সে দ্বিধা।
বড়ো তৃষ্ণা ওষ্ঠ জ্বালিয়ে নেমে যাচ্ছে বুকের ভেতর
সামনে কে তুমি?
অর্জুন!
একটু সরে দাঁড়াও, আমাকে দেখতে দাও
বিদায়বেলার সূর্য।
আর কার মুখ ঝুঁকে পড়ছে চোখের উপর!
আমাকে মার্জনা করবেন, পিতা অধিরথ ;
আর অর্জুন, আমার তূণীর থেকে তুলে নাও একটি তীর
ধনুকে রোপন করো জ্যা, দূর গঙ্গাতীরে নিস্তব্ধ কুটিরে
একাকিনী রাধার কাছে পৌঁছে দাও আমার প্রণাম।
আর হে মৃত্তিকা, জীবনে এই প্রথম মাথা রাখলাম
তোমার কোলে ; গ্রহণ করো আমাকে।