বাবার চেয়ার কবিতা শুভ দাশগুপ্ত
আমাদের পুরনো বাড়িতে একটা সেগুন কাঠের চেয়ার ছিল।
বেশ লম্বা হাতলওয়ালা। পিঠের ঠেস দেবার জায়গায় চারটে বড় পাটি।
বসার জায়গাটাও অনেক বড়।
বাবা ওই চেয়ারটাতে বসতেন। বসে খবরের কাগজ পড়তেন,
ডায়েরি লিখতেন। হিসেব লিখতেন। বন্ধুরা কেউ এলে ওই চেয়ারে বসে
গল্প করতেন। ঐ চেয়ারে সকাল বিকেল বাবা চা খেতেন বসে।
বর্ষার দিনে ঐ চেয়ারে পা তুলে বসে
মুড়ি তেলেভাজাও খেতেন।
নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছি এখন
তার কোন ঘরেই চেয়ারটা ঠিকমত রাখা যাচ্ছিল না।
নতুন সব আসবাবের মধ্যে চেয়ারটা অসম্ভব বেমানান!
কিন্তুর বাবার মতোই, বাবার ঐ চেয়ারটাও আমার ভীষণ প্রিয়!
ওটা ফেলে দেব বা বিক্রী করে দেব— কোনটাই ভাবতে পারিনা
চেয়ারটা দেখলেই বাবার কথা মনে পড়ে।
বাবা চেয়ারটায় বসে মহাভারত পড়তেন। গীতা পড়তেন।
রবীন্দ্রনাথ পড়তেন।
চেয়ারটার গায়ে হাত রাখলেই আমার এখনও
মহাভারত গীতা রবীন্দ্রনাথ কানের মধ্যে বেজে ওঠে।
তবু
সেই চেয়ারটাকে রাখতে পারলাম না।
নতুন কেনা একটা স্টীলের আলমারি ঘরে ঢোকানোর সময়
ধাক্কা লেগে চেয়ারটা ভেঙে গেল। একটা পা জখম হয়ে গেল।
তারপর থেকে
ফ্ল্যাটবাড়ির ছাতে— জলের ট্যাঙ্কের পাশে এক কোণায়
চেয়ারটা পড়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। রোদে পুড়ছে।
তবু
ছাতে গিয়ে সেই চেয়ারটার দিকে চোখ পড়লে— বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ে।
একদিন ভোর রাতের স্বপ্নে বাবাকে দেখলাম।
বাবা বললেন :
খোকন! আমার আলমারিতে ছিল মহাভারত। ছিল গীতা,
(রামায়ণ, রবীন্দ্রনাথ)
তোর আলমারিতে শেয়ারের কাগজ, ব্যাঙ্কের পাস বই আর স্কচের বোতল।
আমার খাতাপত্রে আমি লিখতাম গান, কবিতা।
লিখে রাখতুম সুভাষ বোসের বক্তৃতার সারাংশ।
তুই তোর নোটবুকে ডাইরিতে কেবল টাকার হিসাব রাখিস।
খোকন। আমার চেয়ারটাতে বসে
অলস মধ্যাহ্নে আমি ভাবতাম
মাস্টারদার কথা। ঋষি অরবিন্দের কথা। শ্রীরামকৃষ্ণের কথা
আর ঐ চেয়ারে বসে তুই এখন
গল্প করিস নোংরা রাজনীতির ? না, খোকন—
ও চেয়ার তুই ছুঁস না। হ্যাঁ খোকন— তুই ও চেয়ারের যোগ্য নয়।
ঘুম যখন আচমকা ভেঙে গেল— দৌড়ে ছাতে গেলাম।
দেখলাম—
চেয়ারটা আপনিই ভেঙেছে, পড়ে আছে একলা ছাতে।