Chandali (Rathjatra) kobita চন্ডালী (রথযাত্রা) কবিতা – কুমুদ রঞ্জন মল্লিক
বৃদ্ধ খঞ্জ চণ্ডালী এক শ্রীমুখ দেখিতে রথে
একাকিনী যায়, চলে ধীরি ধীরি মেদিনীপুরের পথে।
দিবসে যে শুধু হাঁটে এক ক্রোশ, তাহার একি গো দায়,
গৃহ হতে দূরে একশত ক্রোশ পুরীধাম যেতে চায়।
দলে দলে চলে পুরীর যাত্রী খোঁজ করে কেবা কার!
সেই সবাকার পিছু পড়ে থাকে, চলিতে পারে না আর।
রথযাত্রার যবে শুধু আর দুই দিন বাকি আছে,
বহু কষ্টে সে পঁহুছিল সাঁঝে আসি কটকের কাছে।
“কোথা যাবি বুড়ি?”-পথিক জনেক শুধালো সেখানে তারে।
বৃদ্ধা বলিল-“চলিয়াছি বাবা, চাঁদমুখ দেখিবারে।”
ঈষৎ হাসিয়া কহিল সে-জন-“কেমনে পারিবি বুড়ি,
রাত পোহালে যে কাল রথ খেপী, দেখিবি কেমন করি’?”
শুনি চণ্ডালী রুষিয়া বলিল-“বাকি যে এখনও পথ,
কি বলিছ তুমি রাতি পোহাইলে কেমনে চলিবে রথ?”
হাসিয়া পথিক বলিল-“তাই তো, চল্ তাড়াতাড়ি চল্-
তুই, খেপী, যদি না যাইবি সেথা, রথ কে টানিবে বল্!”
ঘুমাইল বুড়ি, রজনী প্রভাতে উঠে বলে-“চল যাই”-
দুটি পা তাহার বেদনা-জড়িত উঠিতে শকতি নাই।
আড়ষ্ট ব্যথা, পারে না নড়িতে, তবু দিয়া হামাগুড়ি,
রথেতে দেখিবে শ্রীমুখ বলিয়া চলিতে লাগিল বুড়ি!
ভক্ত কত না জুটেছে শ্রীধামে, রথযাত্রা যে আজি,
কাঙালের হরি উঠেছেন রথে অভিনব বেশে সাজি,
একি অঘটন, একি হল আজ, চলে না দেবের রথ!
অজুত ভক্ত টানে রশি ধরি, কর্দমহীন পথ।
জুড়িল হস্তী তবু যে গো রথ তেমনি রহিল থির;
ভাবনা-ব্যাকুল প্রধান পাণ্ডা, ঝরে নয়নের নীর।
ধুলার মাঝারে লুটায়ে পাণ্ডা জানিতে পারিল ধ্যানে-
প্রবল ভক্ত কে-এক রথের পশ্চাৎ দিকে টানে।
যাবৎ না ছোঁয় সমুখের রশি শুচি করতলে তার,
হাজার হস্তী রথের চক্র নড়াতে নারিবে আর।
বাহির হইল পাণ্ডার দল ভক্ত-অন্বেষণে-
কৌপীন-পরা সন্ন্যাসী যত ধরে আনে জনে জনে।
তিলক-ভূষিত নামাবলী-ধারী বৈষ্ণব আনে ধরে,
কাহারো পরশে সে বিরাট রথ এক তিল নাহি নড়ে!
খুঁজিতে খুঁজিতে বহুদূরে আসি প্রধান পাণ্ডা, হায়,
দেখিল খঞ্জ বৃদ্ধা জনেক পুরী অভিমুখে যায়।
হামাগুড়ি দিয়া চলিয়াছে বুড়ি; পাণ্ডা শুধালো তারে-
“এ খর-রৌদ্রে ভিক্ষার লাগি যাইবি কাহার দ্বারে?
তপ্ত বালুতে পুড়িতেছে পথ, আঁখি ভরে গেছে জলে-
দিনু এই সিকি, ফিরে গিয়ে বোস্ ওই অশথের তলে।”
বুড়ি বলে-“বাবা, বল কবে রথ, পয়সাতে কাজ নাই,
রথেতে দেখিব শ্রীমুখ বলিয়া রোদে চলিয়াছি তাই।”
শুনি ব্রাহ্মণ কাঁদিতে কাঁদিতে বৃদ্ধারে বুকে করি
“পেয়েছি, পেয়েছি”-বলিয়া ছুটিল পুরীর সড়ক ধরি।
ব্যাকুল বৃদ্ধা বলে-“দাও ছাড়ি, বাবা গো চাঁড়াল মুই।”
ব্রাহ্মণ বলে-“দে মা পদধূলি, গুরুর গুরু যে তুই।”
চকিতে দেখিল যাত্রীরা সবে,”জয় জয় জয়” বলে-
প্রধান পাণ্ডা আসিল যে সেই খোঁড়া বুড়ি লয়ে কোলে।
অচল সে রথ চলিতে লাগিল, বুড়ি দিল যবে হাত-
উল্লাসে সবে গাহিয়া উঠিল-“ধন্য জগন্নাথ!”
সাশ্রু-নয়নে অজুত ভক্ত গাহিল ভক্তি-গান-
“সত্যই তুমি কাঙালের হরি ভক্তের ভগবান!”