Chonnochara poem lyrics ছন্নছাড়া (কবিতা) – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

Chonnochara kobita lyrics ছন্নছাড়া - অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

 

গলির মোড়ে একটা গাছ দাঁড়িয়ে
গাছ না গাছের প্রেতচ্ছায়া-
আঁকাবাঁকা শুকনো কতকগুলি কাঠির কঙ্কাল
শুন্যের দিকে এলোমেলো তুলে দেওয়া,
রুক্ষ রুষ্ট রিক্ত জীর্ণ
লতা নেই পাতা নেই ছায়া নেই ছাল-বাকল নেই
নেই কোথাও এক আঁচড় সবুজের প্রতিশ্রুতি
এক বিন্দু সরসের সম্ভাবনা।

ওই পথ দিয়ে
জরুরী কাজে যাচ্ছিলাম ট্যাক্সি করে।
ড্রাইভার বললে, ও দিকে যাব না।
দেখছেন না ছন্নছাড়া কটা বেকার ছোকরা
রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে-
চোঙা প্যান্ট,চোখা জুতো,রোখা মেজাজ,ঠোকা কপাল-
ওখান দিয়ে গেলেই গাড়ি থামিয়ে লিফট চাইবে,
বলবে হাওয়া খাওয়ান।

কারা ওরা ?
চেনেন না ওদের ?
ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের- এক নেই-রাজ্যের বাসিন্দে ।
ওদের কিছু নেই
থিত নেই ভিত নেই রীতি নেই নীতি নেই
আইন নেই কানুন নেই বিনয় নেই ভদ্রতা নেই
শ্লীলতা-শালীনতা নেই ।
ঘেঁসবেন না ওদের কাছে ।

কেন নেই ?

ওরা যে নেই-রাজ্যের বাসিন্দে-
ওদের জন্য কলেজে সিট নেই
অফিসে চাকরি নেই
কারখানায় কাজ নেই
ট্রামে বাসে জায়গা নেই
খেলায়-মেলায় টিকিট নেই
হাসপাতালে বেড নেই
বাড়িতে ঘর নেই
খেলবার মাঠ নেই
অনুসরণ করবার নেতা নেই
প্রেরণা জাগানো প্রেম নেই
ওদের প্রতি সম্ভাষণে কারুর দরদ নেই-
ঘরে-বাইরে উদাহরণ যা আছে
তা ক্ষুধাহরণের সুধাক্ষরণের উদাহরণ নয়
তা সুধাহরণের ক্ষুধাভরণের উদাহরণ-
শুধু নিজের কোলের দিকে ঝোল-টানা ।
এক ছিল মধ্যবিত্ত বাড়ির এক চিলতে ফালতু একটু রক
তাও দিয়েছে লোপাট করে।
তাই এখন পথে এসে দাঁড়িয়েছে সড়কের মাঝখানে।
কোথ্থেকে আসছে সেই অতীতের স্মৃতি নেই
কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেই বর্তমানে গতি নেই
কোথায় চলেছে নেই সেই ভবিষ্যতের ঠিকানা ।

সেচ-হীন ক্ষেত
মনি-হীন চোখ
চোখহীন মুখ
একটা স্ফুলিঙ্গ-হীন ভিজে বারুদের স্তুপ ।

আমি বললুম, না , ওখান দিয়েই যাব,
ওখান দিয়েই আমার শর্টকাট ।

ওদের কাছাকাছি হতেই মুখ বাড়িয়ে
জিঙ্গেস করলুম,
তোমাদের ট্যাক্সি লাগবে ? লিফট চাই ?
আরে এই তো ট্যাক্সি, এই তো ট্যাক্সি, লে হালুয়া,
সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো ছোকরারা
সিঠি দিয়ে উঠলো
পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি, চল পানসি বেলঘরিয়া।
তিন-তিনটে ছোকরা উঠে পড়লো ট্যাক্সিতে,
একজন ড্রাইভারের পাশে ,দুজন পিছনের সিটে ।
বললুম, কদ্দুর যাবে ?
এই কাছেই । ঐ দেখতে পাচ্ছেন না ভীড় ?
সিনেমা না, জলসা না , নয় কোন ফিল্মী তারকার অভ্যর্থনা।
একটা নিরীহ লোক গাড়ীচাপা পড়েছে,
চাপা দিয়ে গাড়ীটা উধাও-
আমাদের দলের কয়েকজন গাড়িটার পিছে ধাওয়া করেছে
আমরা খালি ট্যাক্সি খুঁজছি ।
কে সে লোক ?
একটা বেওয়ারিশ ভিখিরি
রক্তে মাংসে দলা পাকিয়ে গেছে।
ওর কেউ নেই কিছু নেই
শোবার জন্য ফুটপাথ আছে তো মাথার উপরে ছাদ নেই,
ভিক্ষার জন্যে একটা পাত্র আছে তো
তার মধ্যে এক বিরাট ফুটো ।

রক্তে মাখামাখি সেই দলা-পাকানো ভিখিরিকে
ওরা পাজাঁকোলা করে ট্যাক্সির মধ্যে তুলে দিল ।
চেঁচিয়ে উঠলো সমস্বরে- আনন্দে ঝংকৃত হয়ে-
প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে ।

রক্তের দাগ থেকে আমার ভব্যতা ও শালীনতাকে বাঁচাতে গিয়ে
আমি নেমে পড়লেম তাড়াতাড়ি ।

তারপর সহসা শহরের সমস্ত কর্কশে-কঠিনে
সিমেন্টে- কংক্রিটে
ইটে-কাঠে-পিচে-পাথরে দেয়ালে-দেয়ালে
বেজে উঠলো এক দুর্বার উচ্চারণ
এক প্রত্যয়ের তপ্ত শঙ্খধ্বনি-
প্রাণ আছে, এখনো প্রান আছে,
প্রাণ থাকলেই স্থান আছে মান আছে
সমস্ত বাধাঁ-নিষেধের বাইরেও
আছে অস্তিত্বের অধিকার ।

ফিরে আসতেই দেখি
গলির মোড়ে গাছের সেই শুকনো বৈরাগ্য বিদীর্ণ করে
বেরিয়ে পড়েছে হাজার হাজার সোনালি কচি পাতা
মর্মরিত হচ্ছে বাতাসে,
দেখতে দেখতে গুচ্ছে-গুচ্ছে উথলে উঠছে ফুল
ঢেলে দিয়েছে বুকের সুগন্ধ,
উড়ে এসেছে রঙ বেরঙের পাখি
শুরু করেছে কলকন্ঠের কাকলি,
ধীরে ধীরে ঘন পত্রপুঞ্জে ফেলেছে স্নেহার্দ দীর্ঘছায়া
যেন কোন শ্যামল আত্মীয়তা ।
অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে দেখলুম
কঠোরের প্রচ্ছন্নে মাধুর্যের বিস্তীর্ণ আয়োজন।
প্রাণ আছে, প্রাণ আছে- শুধু প্রাণই এক আশ্চর্য সম্পদ
এক ক্ষয়হীন আশা
এক মৃত্যুহীন মযার্দা ।

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।