হিং টিং ছট্ (কবিতা) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Hing ting chot poem

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

হিং টিং ছট্ (কবিতা) - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Hing ting chot poem Rabindranath Tagore

 

স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ —

অর্থ তার ভাবি ভাবি গবুচন্দ্র চুপ।

শিয়রে বসিয়ে যেন তিনটে বাদঁরে

উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে —

একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড় ,

চোখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড় ।

সহসা মিলালো তারা , এল এক বেদে,

‘পাখি উড়ে গেছে ‘ ব‘লে মরে কেঁদে কেঁদে।

সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে ,

ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচু এক দাঁড়ে।

নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়থুড়ি

হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়সুড়ি।

রাজা বলে ‘কী আপদ ‘ কেহ নাহি ছাড়ে—

পা দুটা তুলিতে চাহে , তুলিতে না পারে ।

পাখির মত রাজা করে ঝটপট্

বেদে কানে কানে বলে —- হিং টিং ছট্।

স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান।।

 

হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয় –সাত

চোখে কারো নিদ্রা নাই, পেটে নাই ভাত।

শীর্ণ গালে হাত দিয়ে নত করি শির

রাজ্যসুদ্ধ বালকবৃদ্ধ ভেবেই অস্থির ।

ছেলেরা ভুলেছে খেলা, পন্ডিতেরা পাঠ,

মেয়েরা করেছে চুপ এতই বিভ্রাট।

সারি সারি বসে গেছে, কথা নাহি মুখে,

চিন্তা যত ভারী হয় মাথা পড়ে ঝুঁকে ।

ভুঁইফোঁড় তত্ত্ব যেন ভূমিতলে খোঁজে,

সবে যেন বসে গেছে নিরাকার ভোজে।

মাঝে মঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া উৎকট

হঠাৎ ফুকারি উঠে-হিং টিং ছট্।

স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।

 

চারি দিক হতে এল পন্ডিতের দল—

অযোধ্যা কনোজ কাঞ্চী মগধ কোশল।

উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস

কালিদাস কবীন্দ্রের ভাগিনেয় বংশ।

মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা,

ঘন ঘন নাড়ে বসি টিকিসুদ্ধ মাথা।

বড়ো বড়ো মস্তকের পাকা শস্যখেত

বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ- সমেত।

কেহ শ্রুতি, কেহ স্মৃতি, কেহ-বা পুরাণ,

কেহ ব্যাকারণ দেখে, কেহ অভিধান ।

কোনোখানে নাহি পায় অর্থ কোনোরূপ,

বেড়ে ওঠে অনুস্বর-বিসর্গের স্তূপ।

চুপ করে বসে থাকে, বিষম সংকট,

থেকে থেকে হেঁকে ওঠে -হিং টিং ছট্।

স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।

 

কহিলেন হতাশ্বাস হবুচন্দ্ররাজ,

ম্লেচ্ছদেশে আছে নাকি পন্ডিত সমাজ–

তাহাদের ডেকে আন যে যেখানে আছে,

অর্থ যদি ধরা পড়ে তাহাদের কাছে।‘

কটা-চুল নীলচক্ষু কপিশকপোল

যবন পন্ডিত আসে , বাজে ঢাক ঢোল ॥

গায়ে কলো মোটা মোটা ছাঁটাছোঁটা কুর্তি-

গ্রীষ্ম তাপে উষ্মা বাড়ে, ভারি উগ্রমূর্তি।

ভূমিকা না করি কিছু ঘড়ি খুলি কয়,

‘সতেরো মিনিট মাত্র রয়েছে সময়—-

কথা যদি থাকে কিছু বলো চট্পট্।‘

সভাসুদ্ধ বলি উঠে – হিং টিং ছট্।

স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান ।।

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।

 

স্বপ্ন শুনি ম্লেচ্ছমুখ রাঙা টকটকে,

আগুন ছুটিতে চায় মুখে আর চোখে ।

কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান ,

যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান ।

অর্থ চাই? রাজ কোষে আছে ভূরি ভূরি –

রাজ স্বপ্নে অর্থ নাই যত মাথা খুড়ি ।

নাই অর্থ, কিন্তু তবু কহি অকপট

শুনিতে কী মিষ্ট আহা –হিং টিং ছট্।’

স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুন্যবান।।

 

শুনিয়া সভাস্থ সবে করে ধিক্-ধিক ,

কোথাকার গন্ডমূর্খ পাষন্ড নাস্তিক!

স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন মাত্র মস্তিষ্ক বিকার

এ কথা কেমন করে করিব স্বীকার !

জগৎ বিখ্যাত মোরা ‘ধর্মপ্রাণ‘ জাতি–

স্বপ্ন উড়াইয়ে দিবে! দুপুরে ডাকাতি!

হবুচন্দ্র রাজা কহে পাকালিয়া চোখে,

‘গবুচন্দ্র, এদের উচিত শিক্ষা হোক ।

হেঁটোয় কন্টক দাও , উপরে কন্টক,

ডালকুত্তাদের মাঝে করহ বন্টক‘।

সতেরো মিনিট—কাল না হইতে শেষ

ম্লেচ্ছ পন্ডিতের আর না মিলে উদ্দেশ।

সভাস্থ সবাই ভাসে আনন্দাশ্রুনীরে,

ধর্মরাজ্যে পুনর্বার শান্তি এল ফিরে।

পন্ডিতেরা মুখচক্ষু করিয়া বিকট

পুনর্বার উচ্চারিল —- হিং টিং ছট্

স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।

 

অতঃপর গৌড় হতে এল হেন বেলা

যবন পন্ডিতদের গুরু মারা চেলা।

নগ্নশির, সজ্জা নাই, লজ্জা নাই ধড়ে—-

কাছা কোঁচা শতবার খ‘সে খ‘সে পড়ে।

অস্তিত্ব আছে না আছে , ক্ষীণখর্ব দেহ,

বাক্য যবে বহিরায় না থাকে সন্দেহ।

এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়

দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময়।

না জানে অভিবাদন, না পুছে কুশল ,

পিতৃনাম শুধাইলে উদ্যতমুষল।

সগর্বে জিজ্ঞাসা করে, কী লয়ে বিচার!

শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই- চার,

ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট্পালট।‘

সমস্বরে কহে সবে –হিং টিং ছট্

স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।

 

স্বপ্ন কথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া

কহিল গৌড়ীয় সাধু প্রহর ধরিয়া ,

‘নিতান্ত সরল অর্থ, অতি পরিস্কার—

বহু পুরাতন ভাব, নব আবিস্কার ।

ত্র্যম্বকের ত্রিয়ন ত্রিকাল ত্রিগুন

শক্তিভেদে ব্যাক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ।

বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি

জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী।

আকর্ষন বিকর্ষন পুরুষ প্রকৃতি।

আণব চৌম্বক বলে আকৃতি বিকৃতি।

কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ

ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভুদ।

ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট,

সংক্ষেপে বলিতে গেলে—হিং টিং ছট্

স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।

 

‘ সাধু সাধু সাধু ‘ রবে কাঁপে চারি ধার–

সবে বলে , ‘পরিস্কার, অতি পরিস্কার!‘

দুর্বোধ যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল,

শন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল।

হাঁপ ছাড়ি উঠিলেন হবুচন্দ্ররাজ,

আপনার মাথা হতে খুলি লয়ে তাজ

পরাইয়া দিল ক্ষীণ বাঙালির শিরে—

ভারে তার মাথা টুকৃ পড়ে বুঝি ছিড়ে।

বহু দিন পরে আজ চিন্তা গেল ছুটে,

হাবুডুবু হবুরাজ্য নড়িচড়ি ওঠে।

ছেলেরা ধরিল খেলা, বৃদ্ধেরা তামুক-

এক দন্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ।

দেশ-জোড়া মাথা-ধরা ছেড়ে গেল চট্,

সবাই বুঝিয়া গেল-হিং টিং ছট্

স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।

 

যে শুনিবে এই স্বপ্ন মঙ্গলের কথা

সর্বভ্রম ঘুচে যবে, নহিবে অন্যথা।

বিশ্বে কভূ বিশ্ব ভেবে হবে না ঠকিতে,

সত্যেরে সে মিথ্যা বলি বুঝিবে চকিতে।

যা আছে তা নাই আর নাই যাহা আছে,

এ কথা জাজ্বল্যমান হবে তার কাছে ।

সবাই সরল ভাবে দেখিবে যা-কিছু

সে আপন লেজুড় জুড়িবে তার পিছু।

এসো ভাই, তোল হাই, শুয়ে পড়ো চিত,

অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত—

জগতে সকলেই মিথ্যা, সব মায়াময়,

স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়।

স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।