হােরিখেলা (কবিতা) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁরে
কেতুন হতে ভূনাগ রাজার রানী,
“লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া-
এসাে তােমার পাঠান সৈন্য নিয়া,
হােরি খেলব আমরা রাজপুতানী।”
যুদ্ধে হারি কোটা শহর ছাড়ি
কেতুন হতে পত্র দিল রানী।
পত্র পড়ি কেসর উঠে হাসি
মনের সুখে গোঁফে দিল চাড়া।
রঙিন দেখে পাগড়ি পরে মাথে,
সুর্মা আঁকি দিল আঁখির পাতে,
গন্ধ-ভরা রুমাল নিল হাতে,
সহস্রবার দাড়ি দিল ঝাড়া।
পাঠান-সাথে হােরি খেলবে রানী-
কেসর হাসি গোঁফে দিল চাড়া।
ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
বকুলবনে মাতাল হয়ে এল।
বােল ধরেছে আমের বনে বনে,
ভ্রমরগুলাে কে কার কথা শােনে-
গুনগুনিয়ে আপন মনে মনে
ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এলােমেলো।
কেতুনপুরে দলে দলে আজি
পাঠান সেনা হােরি খেলতে এল।
কেতুনপুরে রাজার উপবনে
তখন সবে ঝিকিমিকি বেলা।
পাঠানেরা দাঁড়ায় বনে আসি,
মুলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি,
এল তখন একশাে রানীর দাসী
রাজপুতানী করতে হােরিখেলা।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা,
সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
ওড়না ওড়ে দক্ষিনে বাতাসে।
ডাহিন হাতে বহে ফাগের থারি,
নীবিবন্ধে ঝুলিছে পিচকারি-
বাম হস্তে গুলাব-ভরা ঝারি-
সারি সারি রাজপুতানী আসে।
পায়ে পায়ে ঘাঘরা উঠে দুলে,
ওড়না ওড়ে দক্ষিনে বাতাসে।
আঁখির ঠারে চতুর হাসি হেসে
কেসর তবে কহে কাছে আসি,
“বেঁচে এলেম অনেক যুদ্ধ করি,
আজকে বুঝি জানে-প্রাণে মরি।”
শুনে রানীর শতেক সহচরী
হঠাৎ সবে উঠল অট্টহাসি।
রাঙা পাগড়ি হেলিয়ে কেসর খাঁ
রঙ্গভরে সেলাম করে আসি।
শুরু হল হােরির মাতামাতি,
উড়তেছে ফাগ রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
নব বরন ধরল বকুলফুলে,
রক্তরেণু ঝরল তরুমূলে,
ভয়ে পাখি কূজন গেল ভুলে
রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে।
কোথা হতে রাঙা কুজ্ঝটিকা
লাগল যেন রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
‘চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা’
মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ,
‘বক্ষ কেন উঠছে নাকো দুলি,
নারীর পায়ে বাঁকা নূপুরগুলি,
কেমন যেন বলছে বেসুর বুলি,
তেমন ক’রে কাঁকন বাজছে না।’
‘চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা’
মনে মনে ভাবছে কেসর-খাঁ।
পাঠান কহে, “রাজপুতানীর দেহে
কোথাও কিছু নাই কি কোমলতা।
বাহুযুগল নয় মৃণালের মতাে,
কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত,
বড়াে কঠিন শুষ্ক স্বাধীন যত
মঞ্জরিহীন মরুভূমির লতা।’
পাঠান ভাবে, দেহে কিম্বা মনে
রাজপুতানীর নাইকো কোমলতা।
তান ধরিয়া ইমন ভূপালিতে
বাঁশি বেজে উঠল দ্রুত তালে।
কুগুলেতে দোলে মুক্তামালা,
কঠিন হাতে মােটা সােনার বালা-
দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
রানী বনে এলেন হেনকালে।
তান ধরিয়া ইমন ভূপালিতে
বাঁশি তখন বাজছে দ্রুত তালে।
কেসর কহে, “তােমারি পথ চেয়ে
দুটি চক্ষু করেছি প্রায় কানা।”
রানী কহে, “আমারও সেই দশা!”
একশাে সখী হাসিয়া বিবশা—
পাঠান-পতির ললাটে সহসা
মারেন রানী কাঁসার থালাখানা।
রক্তধারা গড়িয়ে প’ড়ে বেগে
পাঠান-পতির চক্ষু হল কানা।
বিনা মেঘে বজ্ররবের মতাে
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
জ্যোৎস্নাকাশে চমকে ওঠে শশী,
ঝনঝনিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে অসি,
সানাই তখন দ্বারের কাছে বসি
গভীর সুরে ধরল কানাড়া।
কুঞ্জবনের তরুতলে-তলে
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
বাতাস বেয়ে ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
মন্ত্রে যেন কোথা হতে কে রে
বাহির হল নারীসজ্জা ছেড়ে,
এক শত বীর ঘিরল পাঠানেরে
পুষ্প হতে একশো সাপের মতো।
স্বপ্নসম ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
ফাগুন-রাতে কুঞ্জবিতানে
মত্ত কোকিল বিরাম না জানে,
কেতুনপুরে বকুল-বাগানে
কেসর খাঁয়ের খেলা হল সারা।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।