সুপ্তোত্থিতা (কবিতা) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Suptothita poem Rabindranath

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

সুপ্তোত্থিতা (কবিতা) - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Suptothita poem Rabindranath Tagore

 

ঘুমের দেশে ভাঙিল ঘুম, উঠিল কলস্বর ।

গাছের শাখে জাগিল পাখি, কুসুমে মধুকর ।

অশ্বশালে জাগিল ঘোড়া, হস্তীশালে হাতি ।

মল্লশালে মল্ল জাগি ফুলায় পুন ছাতি ।

জাগিল পথে প্রহরীদল, দুয়ারে জাগে দ্বারী,

আকাশে চেয়ে নিরখে বেলা জাগিয়া নরনারী ।

উঠিল জাগি রাজাধিরাজ, জাগিল রানীমাতা ।

কচলি আঁখি কুমার-সাথে জাগিল রাজভ্রাতা ।

নিভৃত ঘরে ধূপের বাস, রতন-দীপ জ্বালা,

জাগিয়া উঠি শয্যাতলে শুধালো রাজবালা—

                             ‘কে পরালে মালা ! ‘

 

খসিয়া-পড়া আঁচলখানি বক্ষে তুলে নিল ।

আপন-পানে নেহারি চেয়ে শরমে শিহরিল ।

ত্রস্ত হয়ে চকিত চোখে চাহিল চারি দিকে—

বিজন গৃহ, রতন-দীপ জ্বলিছে অনিমিখে ।

গলার মালা খুলিয়া লয়ে ধরিয়া দুটি করে

সোনার সূতে যতনে গাঁথা লিখনখানি পড়ে।

পড়িল নাম, পড়িল ধাম, পড়িল লিপি তার,

কোলের ‘পরে বিছায়ে দিয়ে পড়িল শতবার ।

শয়নশেষে রহিল বসে, ভাবিল রাজবালা—

‘আপন ঘরে ঘুমায়ে ছিনু নিতান্ত নিরালা,

                             ‘কে পরালে মালা !’

 

নূতন-জাগা কুঞ্জবনে কুহরি উঠে পিক,

বসন্তের চুম্বনেতে বিবশ দশ দিক ।

বাতাস ঘরে প্রবেশ করে ব্যাকুল উচ্ছাসে,

নবীনফুলমঞ্জরীর গন্ধ লয়ে আসে ।

জাগিয়া উঠে বৈতালিক গাহিছে জয়গান,

প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে বাঁশিতে উঠে তান ।

শীতলছায়া নদীর পথে কলসে লয়ে বারি—

কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে, চলিছে পুরনারী ।

কাননপথে মর্মরিয়া কাঁপিছে গাছপালা,

আধেক মুদে নয়ন দুটি ভাবিছে রাজবালা—

                             ‘কে পরালে মালা !’

 

বারেক মালা গলায় পরে, বারেক লহে খুলি—

দুইটি করে চাপিয়া ধরে বুকের কাছে তুলি ।

শয়ন -‘পরে মেলায়ে দিয়ে তৃষিত চেয়ে রয়,

এমনি করে পাইবে যেন অধিক পরিচয় ।

জগতে আজ কত-না ধ্বনি উঠিছে কত ছলে—

একটি আছে গোপন কথা, সে কেহ নাহি বলে ।

বাতাস শুধু কানের কাছে বহিয়া যায় হূহু,

কোকিল শুধু অবিশ্রাম ডাকছে কুহু কুহু ।

নিভৃত ঘরে পরান মন একান্ত উতালা,

শয়নশেষে নীরবে বসে ভাবিছে রাজবালা—

                             ‘কে পরালে মালা !’

 

কেমন বীর-মুরতি তার মাধুরী দিয়ে মিশা—

দীপ্তিভরা নয়ন-মাঝে তৃপ্তিহীন তৃষা ।

স্বপ্নে তারে দেখেছে যেন এমনি মনে লয়—

ভুলিয়া গেছে রয়েছে শুধু অসীম বিস্ময় ।

পার্শ্বে যেন বসিয়াছিল, ধরিয়াছিল কর,

এখনো তার পরশে যেন সরস কলেবর ।

চমকি মুখ দু হাতে ঢাকে, শরমে টুটে মন,

লজ্জাহীন প্রদীপ কেন নিভে নি সেইক্ষণ !

কন্ঠ হতে ফেলিল হার যেন বিজুলিজ্বালা,

শয়ন-‘পরে লুটায়ে প’ড়ে ভাবিল রাজবালা—

                             ‘কে পরালে মালা !’

 

এমনি ধীরে একটি করে কাটিছে দিন রাতি ।

বসন্ত সে বিদায় নিল লইয়া যূথীজাতি ।

সঘন মেঘে বরষা আসে, বরষে ঝরঝর্,

কাননে ফুটে নবমালতী কদম্বকেশর ।

স্বচ্ছহাসি শরৎ আসে পূর্ণিমামালিকা,

সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা ।

আসিল শীত সঙ্গে লয়ে দীর্ঘ দুখনিশা,

শিশির-ঝরা কুন্দফুলে হাসিয়া কাঁদে দিশা ।

ফাগুন-মাস আবার এল বহিয়া ফুলডালা,

জানালা-পাশে একেলা বসে ভাবিছে রাজবালা—

                             ‘কে পরালে মালা !’

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।